বাঙালীর সকাল বেলা নাস্তার পর এককাপ চা না হলেই নয়!
সকাল- সন্ধ্যা চা যেন আমাদের জীবনের প্রাত্যাহিক রুটিন।
অথচ, চা পানের সময় কখনও কি ভেবেছেন , এই চায়ের উৎপত্তি কিভাবে হলো? কিভাবে চা উৎপাদন হয়? কত শত চা শ্রমিকের আত্নগাঁথা জড়িয়ে আছে, আপনার ওই এক চুমুক চায়ের মাঝে?
জানতে কি ইচ্ছা করেনা?
এসব জানতে হলে, চায়ের ইতিহাস, উৎপাদন , প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে জানতে হবে। আর, সেসব ক্ষেত্রে আপনার আশ্রয় নিতে হবে জাদুঘরের।
আসলেই? বাংলাদেশে চা জাদুঘর আছে?
হ্যা! মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় চা জাদুঘর অবস্থিত।
আজ পুরো লেখায় আমি আপনাকে বলব, টি মিউজিয়াম কিভাবে যাবেন, কি কি দেখবেন, কোথায় খাবেন, কোথায় থাকবেন, সংগ্রহশালাটির ইতিহাস, সময়সূচি এবং প্রবেশমূল্য সম্পর্কে।
পড়তে থাকুন যদি জানতে চানঃ
চা জাদুঘরের ইতিহাস
চা বাগানের মধ্যে অবস্থিত চা সংগ্রহশালায় বাংলাদেশের চা-শিল্পের প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাস ফুটে উঠেছে। চা সম্প্রসারন প্রকল্পের পরিত্যক্ত ভবনের ছোট সেই চারটি কক্ষে যাত্রা লাভ করেছিল জাদুঘরটি । এখনো ওই চার দেয়ালেই “বন্দি” জাদুঘরটি।
চা বোর্ড এর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের দেশে ২০০৯ সালে প্রথম টি মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়।
চা জাদুঘরে কি আছে?
একনজরে, চা জাদুঘরে যা কিছু দেখবেন
- ব্রিটিশ আমলে চা শ্রমিকদের ব্যবহৃত জিনিস পত্র যেমনঃ চা প্রস্তুতকরণ যন্ত্রপাতি, চা-বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কাঁটা কোদাল, রিং কোদাল, তীর-ধনুক।
- চা-গাছ ছাঁটাইকাজে ব্যবহৃত নানা ধরনের ধারালো দা-সহ ব্রিটিশ আমলে চা শ্রমিকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন রকমের হাতিয়ার।
- বাংলায় প্রাচীন বেতারযন্ত্র, দেয়ালঘড়ি, চা-বাগানে চারা লাগানোর কাজে ব্যবহৃত বিশেষ যন্ত্রপাতি।
- মহিলা শ্রমিকদের নুপুর, ঝুমকা, মাদুলি ও বিভিন্ন রকমের রুপার গহনা।
- চা শ্রমিকদের পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত দেবদেবীর কষ্টিপাথরের মূর্তি।
- ইংরেজ আমলের যান্ত্রিক লাঙ্গল, পানির ফিল্টার, ব্রিটিশ বাবুদের ব্যবহৃত টেলিফোন সেট, টাইপ রাইটার, লিফট পাম্প, জরিপ ছিকল, টারবাইন পাম্প, এবং ব্রিটিশ আমলের সার্ভিস বুক।
- ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের রোপ্য ও তামার মুদ্রা।
- বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং মিটিং করার টেবিল ও বসার চেয়ার।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাউয়াছড়া উদ্যানে পতিত হওয়া যুদ্ধবিমানে ধ্বংসাবশেষ।
জাদুঘরটি তেমন বড় নয়। সংগ্রহশালাটির প্রবেশদ্বার চোখে পড়ার মতন।
আপনি জানেন যে, ব্রিটিশ শাসনামলে শ্রীমঙ্গলে চায়ের চাষ হতো।
জাদুঘরটিতে,তখনকার চা শ্রমিকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি যেমনঃ কোদাল, ফিল্টার, রিং, চা গাছের মোড়া এবং আসবাবপত্র রয়েছে।
চা শ্রমিকদের কোদাল, দা, খুন্তি, চয়ন ,ত্রিফলা টাইপের কোদাল এবং কাটার নামক আরো বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে। পাশাপাশি তখনকার মহিলা চা শ্রমিকদের ছিল বিশেষ ধরনের অলঙ্কার। তাদের ব্যবহৃত রুপার অলঙ্কার যেমন নুপুর ,ঝুমকা এবং মাদুলী ইত্যাদিরও দেখা মিলবে এখানে।
শুধুই কি তাই?
সেখানে রয়েছে নেপচুন চা বাগান থেকে সংগৃহীত মাঝারী আকারের ফ্রিজ যেটা চালানো হতো মাঝারী ধরনের কেরোসিনের কুপি দিয়ে!
রয়েছে, মাথিউড়া চা বাগান থেকে সংগ্রহিত ব্রিটিশ আমলের হাতে ঘুরানো টেলিফোন-সেট।
ব্রিটিশ শাসনামলের নানা ধরনের জিনিসপত্রও দ্রষ্টব্য। ব্রিটিশ ম্যানেজার বাবুদের ব্যবহৃত পানির ফিল্টার, লাঙ্গল, টাইপ রাইটার, বিভিন্ন ধরনের টেলিফোন সেট, সিরামিকের বিভিন্ন জিনিস, টারবাইন যন্ত্র, চা-পাতা কাটার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
আরো রয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলে ব্যবহৃত তামা এবং রোপ্য মুদ্রা স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে।

তবে, বিশেষভাবে আপনাকে যা আকৃষ্ট করবে তা হলো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বসার চেয়ার ও মিটিংয়ের টেবিল।
আপনি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন যে, সংগ্রহশালাটির সাথে উনার কি সম্পর্ক বা এই চেয়ারের সাথে এর কি যোগসুত্র?
আচ্ছা, বঙ্গবন্ধু, তৎকালীন (১৯৫৭-১৯৫৮ সালে) চা বাগান বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।
তখন তিনি চা বাগান পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। সে সময় যে চেয়ারে বসে মিটিং করে ছিলেন সেই চেয়ারটি সংরক্ষন করা হয়েছে জাদুঘরটিতে। সাথে রাখা হয়েছে টেবিলটিও।
শুধু সেখানে শেষ নয় কিন্তু দেখার আছে অনেক কিছুই বাকি। উনার সম্মানার্থে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত বঙ্গবন্ধুর আপাদমস্তক প্রতিকৃতি দেখতে পাবেন।
চা জাদুঘরের প্রবেশমূল্য এবং সময়সূচী
চা জাদুঘর প্রতিদিন সকাল ১০ ঘটিকা হইতে বিকাল ৪ ঘটিকা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর, প্রবেশ টিকিট মূল্য মাত্র ২০ টাকা।
টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়াম
১২ টা বাংলো নিয়ে জাদুঘরটির সাথে লাগোয়া সুন্দর একটা রিসোর্ট আছে। বাংলাদেশ চা গবেষনা বোর্ডের মালিকানাধীন এই রিসোর্ট।
মজার একটা তথ্য হলো, এই রিসোর্ট সেই ব্রিটিশ আমলে বাবুরা তৈরি করেছিলেন নিজেদের খায়েশে। আরেকটা জিনিস হলো এই রিসোর্টে একটা মিনি চিড়িয়াখাঁনাও আছে।
এই রিসোর্টে আন্তর্জাতিক মানের কিছু সুবিধা যেমনঃ গেম জোন, সুইমিংপুল, বাথটাব , ২৪ ঘন্টা রুম সার্ভিস , ব্যাকআপ জেনারেটর , অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা এবং রেস্টুরেন্ট (দেশি-বিদেশী খাবার সমৃদ্ধ)।
এখানে ভাড়া কিন্তু খুব বেশি না, ২০০০-৮০০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন মানের বাংলো রয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটে কটেজ ভেদে ভাড়াটা জেনে নিতে পারবেন। ভাড়া ও কটেজগুলির সুবিধাবলি সব একজায়গায় দেখতে এই পিডিএফটা পড়ে আসুন।
এখানে একটা বিষয় আগে থেকে জানা থাকা ভাল যে, টি রিসোর্টের সব কটেজে ভাড়ার সাথে ১৫% শুল্ক যোগ হবে।
চা বোর্ডের এই রিসোর্টের কটেজ বুক দিবেন কিভাবে?
এই নিন তাদের অফিসিয়াল নাম্বারঃ Mob:- 01712-071502, Tel:- 08626-71207
আর এটা হল তাদের মেইল ঠিকানাঃ tearesort@yahoo.com
চা জাদুঘর কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে কিভাবে আসবেন এটা বলে দিচ্ছি, তাতে করে অন্যান্য জেলা থেকে কিভাবে যাবেন, সেটা বুঝে নেয়া আপনার কাছে কেকের মতনই নরম মনে হবে!
আমাদের গন্তব্য ছিল, শ্রীমঙ্গলের চা জাদুঘর। তাহলে ভাইয়া আপনাকে যে প্রথমে শ্রীমঙ্গলে আসতে হবে। ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে যে বাস গুলা ছাড়ে যেমন এনা, হানিফ,শ্যামলী আরো কিছু লোকাল বাস দিয়ে চলে আসতে পারেন শ্রীমঙ্গলে।
শ্রীমঙ্গলের শহর হতে বেছে নিতে হবে আপনাকে কমলগঞ্জ ও শমশের নগরের দিকের রাস্তাটিকে যেটা ভানুগাছা রোড নামে পরিচিত।
ভানুগাছ সড়ক ধরে আপনাকে প্রায় দুই কিলোমিটার এগিয়ে আসতে হবে। রাস্তা থেকে নেমে হাতের বাম পাশে দেখতে পাবেন টি মিউজিয়ামটি।
কোথায় থাকবেন?
আপনি যদি ডে লং ট্যুরে শ্রীমঙ্গল যান তাহলে তো রাতে থাকা নিয়ে আপনাকে ভাবতেই হবে না। রাত নয়টার মধ্যে ঢাকাগামী যেকোন বাসে উঠে পড়লেই সহিসালামতে সময়মত ঢাকা ফিরতে পারবেন।
আর যদি মনে করেন স্বাচ্ছন্দে সবগুলো দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখবেন তাহলে বাজেটের মধ্যে একটা হোটেল কিংবা রিসোর্ট বুকিং দিয়ে ফেলুন। শ্রীমঙ্গলের হোটেল ও রিসোর্ট নিয়ে লেখা রিভিউটা পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন এবং সেখানে নির্দেশিত তথ্যানুযায়ী বুকিং দিয়ে ফেলুন।
খাবেন কোথায়?
আপনার যদি দুপুর নাগাদ জাদুঘরটি ঘুরে দেখা শেষ হয়, তাহলে দুপুরের খাবারের জন্য শ্রীমঙ্গলের সেরা হোটেল হতে পারে পানসী রেস্টুরেন্ট।
টি মিউজিয়ামটি যে সড়কে সেই সড়ক ধরে শ্রীমঙ্গল শহরের দিকে ফিরতি পথে পানসী রেস্টুরেন্ট অবস্থিত।
এখানকার খাবারের মান নিয়ে কোনো দর্শনার্থীরই অভিযোগ নেই। অল্প টাকার মধ্যে এখানে দেশী খাবার যেমন ভাত-ডাল, ভর্তা-ভাজি, মাছ পাবেন। ১২০ টাকার মধ্যে হয়ে যাবে।আর হ্যাঁ , এখানকার খিচুড়ির স্বাদ নিয়ে আসতে পারেন। মাত্র , ৪৫ টাকায় এত অসাধারন খিচুড়ি পাওয়া যায় , সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে।
আপনার উদ্দেশ্য
আমার মত আপনিও যদি ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রেমী হয়ে থাকেন তবে , চা জাদুঘর ঘুরে আসতে পারেন।
সার্বিকভাবে, টি মিউজিয়ামে দেখার মত খুব বেশি কিছু নেই; চা ও বাংলাদেশে চায়ের উৎপত্তি ও চাষ নিয়ে আরও অনেক সংগ্রহ থাকতে পারত।
এছাড়া, চা রোপন থেকে শুরু করে চা পানের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি প্রক্রিয়ার প্রামান্যচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল।
তবে, যা সংগ্রহ আছে সেগুলো মোটামুটি চা চাষ ও শ্রমিকদের দুঃসহ ইতিহাসকে অনুধাবন করিয়ে দিতে যথেষ্ট।
জেনে রাখা ভাল যে, জাদুঘরটি থেকে স্বল্প দূরত্বের মধ্যে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান লাউয়াছড়া উদ্যান ও মাধবপুর লেক অবস্থিত।
পরিশেষে আপনি যদি এ পর্যন্ত পড়ে থাকেন তাহলে কমেন্ট করে জানান কেমন লাগল।
আর হ্যা, একদম আপডেটেড ইনফরশেন পেতে বা প্রশ্ন করে সরাসরি অন্যান্য ভ্রমণপিপাসু মানুষজনের থেকে উত্তর পেতে ভ্রমণচারীর ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হয়ে নিন।
ভ্রমণচারীরা আরও যা জিজ্ঞাসা করে
চা বোর্ড কোথায় অবস্থিত?
চট্রগ্রাম জেলার নাসিরাবাদে অবস্থিত।
চা গবেষণা ইনস্টিটিউট কোথায়?
চা গবেষনা ইনস্টিউট শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। দেশে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মোট ৪ টি উপকেন্দ্রে রয়েছে।
চা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান কার্যালয় কোথায় অবস্থিত?
চা গবেষনা কেন্দ্রের (বিটিআরআই) প্রধান কার্যালয় শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত।