বলধা গার্ডেন: উপমহাদেশের দূর্লভ এক উদ্যানের আত্নকথা

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন? শান্ত-শ্যামল গাছপালায় ভরা সুনশান সুনিবিড় জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে ভালবাসেন?

কেই না পছন্দ করে, তাইনা?

কিন্তু সমস্যা হলো এই যান্ত্রিকতার শহরে সে সুযোগ পাওয়া দুর্লভ। তাই বলে কি অসম্ভব? না অসম্ভব নয়।

প্রকৃতির মেলবন্ধনে হরেক রকমের গাছপালা নিয়ে ঢাকার বুকে তেমনই এক চিরপ্রশান্তির নীড় হলো বলধা গার্ডেন (Baldha Garden)।

বলধা গার্ডেন কোথায় অবস্থিত?

সবুজ পত্রপল্লবে বেষ্টিত বলধা উদ্যানটি ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত।

দর্শনীয় স্থানবলধা গার্ডেন
অবস্থাননারিন্দা, ওয়ারী, ঢাকা
আয়তন৩.৩৮ একর
ড্রোন উড়ানো যাবে?না

বলধা গার্ডেনের নামকরন

এই নন্দন কাননটি কোনো সরকারী সম্পত্তি ছিল না।

১৯০৯ সালে গাজীপুরের বলধার নিঃসন্তান জমিদার রাজ কিশোর রায় চৌধুরীর দত্তক পূত্র জমিদার নারায়ন রায় চৌধুরী সযত্নে গার্ডেনটি  গড়ে তোলেন। বলধা জমিদারের নামানুসারে বাগানটির নামকরন করা হয় “বলধা গার্ডেন”। উল্লেখ্য সেসময় গাজীপুর এলাকা ‘বলধা’ নামে পরিচিত ছিল।

ফিরে দেখাঃ বলধা গার্ডেনের ইতিহাস

ভাওয়াল জমিদার নারায়ন রায় চৌধুরী ছিলেন একজন বিশিষ্ট প্রকৃতি প্রেমিক। সৌখিন এই মানুষটি তার জমিদারীকালীন সময়ে বলধা জমিদার বাড়ির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে বাগানবাড়ি নির্মান করেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে ঢাকার ওয়ারী এলাকায় নির্মিত “কালচার”। অবশ্য তখন সবার কাছে বাড়িটি “বলধা হাউজ” নামে পরিচিত ছিল। জমিদার নারায়ন রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর বলধা হাউজকে তার জমিদারী এলাকার নামানুসারে “বলধা গার্ডেন” নামকরন করা হয়।

উল্লেখ্য, তিনি ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় “নিমফ” নামে আরেকটি বাড়িও নির্মান করেন। এসব ছাড়াও নারায়ন চন্দ্র রায় তার জমিদারীর আওতায় কলকাতা ও দার্জিলিংয়ে ২টি করে এবং পুরি ও লৌখানোতে ১টি করে বাড়ী নির্মান করেন। জমিদার নারায়ন রায় কতটা কৌতুহলী ও সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন এসব তারই প্রমান।

চৌধুরী সাহেব শুধু সুন্দর সুন্দর বাড়ী নির্মান করেই ক্ষ্যান্ত হননি 😎। সৃষ্টিশীল এই মানুষটি ঢাকার ওয়ারী এলাকায় একটি জাদুঘরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে পরে পাকিস্তান সরকার সেটিকে ঢাকা জাদঘরে স্থানান্তর করে।

দাড়ান! আরেকটু ইতিহাস শুনাই দেই।

১৯৪৩ সালে জমিদার নারায়নচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর বলধা বাগানটি পরিচালিত হতো কলকাতা হাইকোর্টের মাধ্যমে। পরে পাকিস্তানী আমলে বাগান তদারকির নানা অনিয়মের অভযোগের কারনে পরিচালনার দায়িত্ব পূর্ব পাকিস্তান বন বিভাগ গ্রহন করে।

বলধা গার্ডেন কিভাবে যাব?

চিন্তা নেই!

বাহারী পত্রপল্লবে পরিপূর্ন এই নন্দনকাননটির অবস্থান ঢাকার ওয়ারীতে।

সূতরাং, ঢাকার যেকোনো স্থান থেকেই অল্প সময়েই যেতে পারবেন।
আচ্ছা, কিভাবে?

যাত্রাবাড়ী অভিমুখে যে বাসগুলো যায়, তার এট্টাই উঠে পড়ুন। রাজধানী সুপার মার্কেট বাস স্টপেজে নামুন। এবার মার্কেটের সামনের হাটখোলা রোড ধরে কিছুক্ষন হাটলেই বলধা উদ্যানে পৌছে যাবেন।

পারবেন তো 😛?

কিন্তু ভাই এই উপায়ে যাওয়াটা আমার জন্য অসুবিধার। অন্য কোনো উপায় আছে কি?

আলবৎ!

বাসে অথবা আপনার সুবিধাজনক বাহনে করে প্রথমে গুলিস্তান আসুন। এবার যে মামাকে মনে ধরে তারে হাঁকাই ডাক দেন 😀। ৩০-৪০ টাকায় নাচতে নাচতে মামায় আপনারে বলধায় নামায় দিবে।

আসল কথাঃ বলধা গার্ডেনে কি দেখবেন?

ভ্রমণ গাইড

জমিদার নরেন্দ্র রায় চৌধুরীর আপন হাতে তিলে তিলে মনের মতো করে সাজানো এই উদ্যানটি দেখতে বেশ মনোরম লাগে। জমিদার সাহেব বাগানের গাছপালা সংগ্রহ করেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। দূর্লভ প্রজাতির নানান উদ্ভিদ, রঙ-বেরঙের নানান ফুলে-ফলে সাজান বাগানটিকে।

বাংলাদেশের মধ্যে শুধু বলধাতেই আছে প্রায় অর্ধশতাধিক বিদেশী প্রজাতির উদ্ভিদ। বর্তমানে বলধার মোট প্রজাতির সংখ্যা ৭৩২ টি আর উদ্ভিদ রয়েছে ১৫,০০০।

তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো এগুলোর বেশিরভাগই বিরল প্রজাতির যা অন্য কোথাও পাওয়া দুস্কর। আর বলধা গার্ডেনের এই বৈশিষ্টই একে উপমহাদেশের অন্যতম ও এক ঐতিহাসিক উদ্যানে রুপান্তর করেছে।

baldha garden
শাপলা হাউজে ফুটন্ত শাপলা
ক্রেডিটঃ Amir Khosru / CC BY-SA (https://creativecommons.org/licenses/by-sa/4.0)

প্রায় সাড়ে তিন একর (৩.৩৮ একর) জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত প্রকৃতির বিস্ময়কর সৌন্দর্যের এই আতুড় ঘরে রয়েছে দুইটি বাগান। একটির নাম সাইকী আরেকটি সিবলী। নাম দুইটি গ্রীক শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। নামের মতন তার অর্থও বেশ বিচিত্র।

সাইকী অর্থ আত্না আর সিবলী হচ্ছে প্রকৃতির দেবতা। সুন্দর নাহ😊? শুধুই কি তাই? বিভিন্ন জাতের শাপলা ফুলে পরিপূর্ন একটি শাপলা হাউজও রয়েছে এখানে।

তাহলে চলেন, সাইকীতে কি আছে আর সীবলীতেই বা কি কি?

সাইকী

গার্ডেনটির সাইকী অংশে রয়েছে বিভিন্ন জাতের শাপলায় (Nymphaea noucheli}) ভরা ‘শাপলা হাউজ’। লাল, নীল, সাদা ও হলুদ রঙের শাপলা ফুটে এই হাউজ অতি মনোরম এক রুপ ধারন করে- মনে হয় যেন এটি দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

বলধা গার্ডেন কিভাবে যাব
বলধার আমাজন লিলি

বিরল জাতের অনেক উদ্ভিদও আছে এই অংশে। ক্যাকটাস, অর্কিড, এনথুরিয়াম, ভূজ্জ পত্র গাছ, আমাজান লিলি, সুরংগ ও বিচিত্র বকুল গাছসমূহ সেসবেরই কতকগুলো। বাগানের এই অংশে একটি ছায়াতর ঘরও রয়েছে।

উল্লেখ্য, বলধা উদ্যানের সাইকী অংশের সর্বসাধারনের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। শুধুমাত্র কতৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গবেষনা বা সম্পর্কিত কাজের জন্য প্রবেশের অনুমতি মিলে।

সিবিলী

মূলত বাগানের এই অংশটিই সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। গার্ডেনের সিবিলী অংশটিই বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে বিস্তৃত।

boldha garden
শীতঁপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ সংরক্ষনের জন্য সিবিলী অংশের গ্রীনহাউজ

এখানে রয়েছে বিখ্যাত ক্যামেলিয়া। একটি  ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করা বাঞ্চনীয়। এই ক্যামেলিয়া গাছের নিচে বসেই রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তার জগৎবিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি। ক্যামেলিয়ার সৌন্দর্যে হয়েছিলেন বিমোহিত-বিমুগ্ধ।

বলধা গার্ডেনের পদ্মফুল ভ্রমণচারী

আর হবেনই বা না কেনো? সীবলী অংশের গোলাপ বাগানে নানা জাতের গোলাপের সংগ্রহ যে পুরো উপমহাদেশ খ্যাত!

সীবলী অংশে আরো রয়েছে শংখ নদ, পুকুর, অশোক, আফ্রিকান টিউলিপস।

তবে এ অংশের সবচেয়ে বড় আকর্ষন হলো সূর্যঘড়ি (sun-dial)। এই ঘড়ির বিশেষত্ব হলো এটি রৌদ্রোজ্জতল দিনে সঠিক সময় দেয়।

বলধা গার্ডেন
সূর্যঘড়ি

অর্থাৎ দিনের রৌদ্রোজ্জলতার সাথে এই ঘড়ির চমৎকার এক কো-রিলেশন রয়েছে। যত রৌদ্রোজ্জল তত নিখুত সময় 😮।

গ্রানহাউজের ঠিক সামনেই সূর্যঘড়ি
গ্রানহাউজের ঠিক সামনেই সূর্যঘড়ি

মজার না ?

এখানেই শেষ নয়! বাগানের এই অংশে আরো রয়েছে ‘আনন্দভবন’ নামে একটি বিশ্রামঘর অন্যকথায় অ্যাম্ফিথিয়েটার। প্রায়শই একে জয় হাউজ (Joy house) নামেও ডাকা হয়।

বলধা গার্ডেন
আনন্দভবন

জমিদার নারায়ন চৌধুরী শুধুমাত্র উপমহাদেশের আবহাওয়া উপযোগী গাছপালা সংগ্রহ করেননি। তিনি অন্যান্য উপমহাদেশ বিশেষত শীতপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদসমূহকে সংরক্ষন করার জন্য এখানে দুটি গ্রীনহাউজ নির্মান করেন।

বলধা উদ্যানের আশেপাশে কোথায় ঘুরে দেখবেন?

যেহেতু পুরান ঢাকায় যাচ্ছেন সেহেতু পাশাপাশি পুরানো ঢাকার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে ঘুরে আসতে পারবেন।

আপনি জানেন কি ঢাকায় বাংলাদেশের বিখ্যাত বিখ্যাত সব ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে?

যেমন?

হাতে একটা দিন সময় নিয়ে গেলে একইসাথে এসমস্ত জায়গাও ঘুরে আসতে পারবেন তাতে করে আলাদা করে এসব জায়গা ঘুরে দেখার জন্য সময় ও অর্থ উভয়ই সাশ্রয় হবে।

কোথায় খাবেন?

ভাই, খাবার নিয়ে উত্তেজিত হবেন না 😛।

আশেপাশে অনেকগুলি রেস্তোরা মালিক আপনার জন্য পুরানো ঢাকার দেশখ্যাত দারুন দারুন সব খানাপিনা নিয়ে বসে আছে।

একটা কথা, বলধা গার্ডেনে প্রবেশ টিকেট মূল্য কত?

বলধা গার্ডেনে প্রবেশ টিকিট মুল্য ২০ টাকা।

তবে ভাই এইটা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। বউ বাচ্চাসহ গেলেও কপালে ভাজ ফেলার কোনো কারন নেই।

বাচ্চাদের প্রবেশ ফি মাত্র ৪ টাকা

ভাই, আমি তো স্টুডেন্ট, ভাই আমি তো বোটানিতে পড়ি-আমার তো শিখতে এমনকি গবেষনার জন্য আসতে হতে পারে। কোনো বিশেষ সুবিধা পাব কি?

হ্যাঁ। আপনি যদি শিক্ষার্থী বা গবেষক হয়ে থাকেন তবে আপনার প্রবেশ টিকিট মুল্য মাত্র ৫ টাকা

বুঝলাম, কিন্তু বলধা গার্ডেনের সময়সূচী?

বলধা গার্ডেন সপ্তাহের ৭ দিনই খোলা থাকে। অর্থাৎ, সাপ্তাহিক কোনো ছুটির দিন নেই। বছরের প্রত্যেক দিনই এই উদ্যান খোলা থাকে।

প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে দুপর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে বন্ধ থাকে।

বলধ গার্ডেনঃ বাঙালী জমিদারের সুরূচিবোধ এবং বাঙালীর আত্নসম্মানবোধ?

নিতান্ত শখের বশে তৈরি সুবিশাল এই উদ্যান চোখে আঙ্গুল দিয়ে বাঙ্গালী জমিদারের তথা বাঙ্গালীর রূচিশীলতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা ও সারসবোধের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। যা আমাদের পরিস্কারভাবে বাঙালীর আত্নসম্মানবোধের পরিচয় তুলে ধরে।

গভীরভাবে একটু চিন্তা করুন!

আমি জানি বাঙ্গালী বড়ই আত্নকেন্দ্রিক। তবে, এই জাতীর আত্নসম্মানবোধ আর   দশটা জাতি থেকে প্রচন্ড।

দ্বিমত?

তাদের জন্য উদাহরন ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান আর ৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ।

ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত বাঙ্গালী সহ্যক্ষমতা অটুট থাকে যতক্ষন পর্যন্ত আত্নসম্মানবোধের মুলে গভীর আঘাত না আসে।

সারকথা

ক্লান্ত এই নগরীর প্রতি মুহূর্ত যেন বিষাক্ত নরকের নিশ্বাস। যত্ন করে গড়ে তোলা অপার সৌন্দর্যে ভরপুর এই বলধা গার্ডেন নগরীর প্রতিটি মূহুর্তের ক্লান্তি মোচন করে তুলবে- একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।

বারবার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহ

বলধা গার্ডেন কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

বলধা গার্ডেন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে।

বলধা গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা কে?

বলধার জমিদার নারায়ন রায় চৌধুরী বলধা গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করেন।

বলধা গার্ডেনের আয়তন কত?

বলধা গার্ডেনের আয়তন প্রায় সাড়ে তিন একর (৩.৩৮ একর)

তথ্যসূত্র

  • মুনতাসীর মামুন, “ঢাকা স্মৃতী বিস্মৃতির নগরী”, পরিবর্ধিত সংস্করন, জুলাই ২০০৮, অনন্য প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা-২৩৩
  • নাজির হোসেন, “কিংবদন্তির ঢাকা”, তৃতীয় সংস্করন, এপ্রিল ১৯৯৫, থ্রিস্টার কো-অপারেটিভ মালটিপারপাস সোসাইটি লিঃ , ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩৬৭
  • বাংলাপিডিয়া

ভ্রমণ, লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় আসক্ত। কাচ্চির আলু আর দুধ খেজুরে পিঠার পাগল। নিজের ভ্রমণ গল্পগুলো লিখি এখানে। ফেসবুক, টুইটারে আমাকে অনুসরন করতে পারেন!

Twitter | Facebook

মন্তব্য করুন