জাফলং ভ্রমণঃ প্রকৃতিকন্যা যেন রূপের পসরা নিয়ে বসে আছে

জাফলং (jaflong) এ কি কি দেখার আছে, কেমনই বা দেখতে, কত সুন্দর তার রূপ! সম্ভবত আপনার মনে এমন প্রশ্ন উকি দিচ্ছে। প্রকৃতি কন্যাকে নিয়ে এমন ভাবনা অতি স্বাভাবিক।

মার্চ, ২০২০।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচ ট্যুর। রীতি অনুযায়ী সেকেন্ড ইয়ার ব্যাচ ট্যুর হয় সিলেটে। রাতে রওনা দিয়েছি। ১২ টা বাজবে হয়ত; হল গেইট থেকে বাসে উঠেছি। প্রথমদিনের প্লান ছিল সরাসরি জাফলং (Jaflong Vromon) যাবার। যাত্রাপথে, ভোর বেলায় সিলেট শহরের নামকরা “পানসি” রেস্তোরা থেকে নাস্তা সেরে বেলা ১১.৩০ এর মধ্যেই পৌঁছে যায় প্রকৃতিকন্যায়!

অসম্ভব সুন্দর। যেমনটা কল্পনা করেছিলাম, তার থেকেও সুন্দর। ডাউকি পাহাড় থেকে প্রবাহমান জলপ্রপাতের কলমর্মর, পিয়াইন নদীর মনমাতানো স্বচ্ছ পানি, শ্বেতপাথরের মোহনীয় রুপ মনকে যেন আকুল করে তোলে।

পাহাড়ের উপর থেকে এসমস্ত কিছু যেনো রুপকথার গল্পে তুলে ধরা কাল্পনিক রুপকেও হার মানায়। মোহণীয় এ রুপ দুর্বল হৃদয়ের মানুষ গভীর ভাবে উপলব্ধি করলে তা তাদের জন্য সহ্যের পর্যায়ে নাও থাকতে পারে ?

ভৌগোলিক অবস্থান ও জাফলং এর নামকরন

জাফলং কোথায় অবস্থিত?

জাফলং এর অবস্থান সিলেট শহর থেকে ৬২ কিমি উত্তর-পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর তীরে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি শহরের কোল ঘেষে প্রকৃতি কন্যা দাড়িয়ে আছে আপন মহিমায়।

জাফলং এর নামকরন কিভাবে হলো?

ইতিহাসবিদদের মতে জাফলং নামকরন করে খাসিয়ারা। জাফলং( ja-phlang বা জা-ফ্লাং ) যা ইংরেজী গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে ja-phlang(জা-ফ্লাং) শব্দটিতে p এর স্থলে f দিয়ে জাফলং শব্দ লেখা হয়েছে। শব্দের বিবর্তনে মধ্য দিয়ে za-phlang>zaphlang>japhlang>japhlang>jaflang>jaflong শব্দটি জাফলং(jaflong) এ পরিনত হয়েছে।

জাফলং কিভাবে যাবেন?

কোটি টাকার প্রশ্ন।

খুব সম্ভবত আপনাদের বেশিরভাগেরই এখানে আসা বিশেষভাবে এই তথ্যটি জানার জন্য। হ্যাঁ। আমরা আপনাদের বুঝি তাই এই টপিকটাতে যত ডিটেইলড ইনফো দেওয়া যায়, সে চেষ্টাই করছি।

চলুন শুরু করা যাক।

ঢাকা থেকে সিলেট

দূরত্ব ও সময়ঃ  ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত সড়ক পথের সর্বমোট দুরত্ব ২৪০ কিমি। আর রেলপথে এ দূরত্ব –কিমি। বাসে করে এ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৬ ঘন্টার মতো, যেখানে ট্রেনে করে যেতে ৭-৮ ঘন্টা লাগে। উড়োজাহাজে চড়ে গেলে মাত্র ৩০ মিনিট লাগবে।

বাই বাস

স্টুডেন্ট? পয়সা বাচাতে চাও?

আরেহ ভাই বাসে যা। ঢাকা টু সিলেট, বাস খুবই সস্তা।

কিভাবে যাব?

প্রথমেই গাবতলী, সায়েদাবাদ,মহাখালী অথবা আব্দুল্লাহপুর বাস টার্মিনালে চলে আসুন।

বাস টার্মিনাল থেকে সিলেট কিভাবে যাবেন , কি কি বাসে যাওয়া যেতে পারে? এই নিন-

এসি বাস

  • এনা পরিবহন
  • গ্রীন লাইন পরিবহন
  • শ্যামলী পরিবহন
  • সৌদিয়া পরিবহন
  • এস আলম পরিবহন

ভাড়াঃ ৮০০-১২০০ টাকা (বাস ও তাদের সার্ভিস ভেদে)

নন এসি

  • শ্যামলী পরিবহন
  • এনা পরিবহন
  • ইউনিক পরিবহন
  • হানিফ পরিবহন

কয়েকটি পরিবহনের যোগাযোগের ঠিকানা নিচে সন্নিবেশিত হল।

পান্থপাথ বাস কাউন্টার

  • হানিফ পরিবহনঃ ফোন- +৮৮০১৭৩৪-০২৬৭০

আরামবাগ কাউন্টার

  • হানিফ পরিবহনঃ ফোন- +৮৮০১৭১৩-৪০২৬৭১
  • শ্যামলী পরিবহনঃ ফোন- +৮৮০১৯৩৬-২৬০২৩*

সায়েদাবাদ কাউন্টার

  • হানিফ পরিবহনঃ ফোন- +৮৮০১৭১৩-৪০২৬৭০*
  • শ্যামলী পরিবহনঃ ফোন- +৮৮০১৭১৮-০৭৫৫৪১, ৭৫১১০১৯, ৭৫৫০০৭১

ভাড়াঃ ৪০০-৫০০ টাকা (বাসভেদে)

আর কি! পছন্দমতো বাসে টিকেট উঠে পড়ুন। আপনার যাত্রা শুভ হোক!

বাই এয়ার

একটু টাকা পয়সা থাকলে আর ফ্যামিলির সাথে যেতে চাইলে ছোট বাচ্চাদের বাসের ঝাকি খাওয়ানোর কি দরকার? ভাই, সদ্য বিবাহিত হইলে, তো কথাই নেই। প্লেনেই যান। একটু পুরানো হোক, বাসে যায়েন।

কিভাবে যাবেন?

সোজা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে চলে আসুন।

ঢাকা থেকে সিলেট কি কি প্লেনে যাবেন? কোন এয়ারলাইন্সে ঢাকা থেকে সিলেট যাবেন?

  • বিমান বাংলাদেশ
  • ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স
  • নভো এয়ারলাইন্স
  • ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স
  • রিজেন্ট এয়ারলাইন্স

বিমান ভাড়া কখনও ফিক্স থাকেনা। প্যাসেঞ্জার, সিজন, ফ্লাইট সংখ্যাসহ বিভিন্ন নিয়ামকের উপর নির্ভর করে বিমান ভাড়া ওঠা-নামা করে।এ কারনে কিছুদিন আগে অনলাইনে টিকিট বুকিং দিয়ে রাখলে বা কিনে ফেললে অনেক কমে পাওয়া যায়।

ভাড়াঃ ইকোনোমিক ক্লাসে ৩০০০-৫০০০ টাকা যেখানে বিজনেস ক্লাসে গেলে গুনতে হবে ১২০০০ টাকার মতো।

বাই ট্রেন

ঢাকা থেকে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ আছে। ভাড়াও বাস, প্লেন অপেক্ষা কম। ঝাকিবিহীন, কেবিন সুবিধা, ওয়াশরম, ফোন চার্জ দেবার সুবিধাছাড়া আরও নানান সুবিধা সংযোগ করে ট্রেন আপনাকে স্বস্তিদায়ক ভ্রমন এনে দিবে।

ঢাকা থেকে সিলেট কিভাবে ট্রেনে করে যাবেন?

ঢাকার কমলাপুর অথবা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে চলে আসুন। সিলেটগামী টিকেট নিয়ে নিন।

ঢাকা থেকে সিলেট কি কি ট্রেনে যাওয়া যায়?

  • উপবন
  • জয়ন্তিকা
  • পারাবাত
  • কালণী

ভাড়াঃ সাধারন শোভন ক্লাসে ভাড়া পড়বে মাত্র ২৮০ টাকা। এসি বা কেবিনভেদে যে ভাড়া ১২০০ টাকা।

রেলস্টেশনের লাইনের ভিড়ে দাড়িয়ে অনেকেরই টিকেট কাটতে ভালো লাগেনা। আরে ভাই চিন্তা কী! আপনি এই আর্টিকেলটি পড়ছেন, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় আপনি দেশের স্মার্ট মানুষজনের একজন। অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কেটে ফেলুন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ই-টিকেটিং ওয়েবসাইটে গিয়ে ড্রপডাউন মেনু থেকে যাত্রাস্টেশন ও গন্তব্যস্টেশন সিলেক্ট করুন। ভ্রমনের দিনক্ষন, সময় ও যাত্রীর ধরন এর ঘর পূরন করে সার্চ করলে কাঙ্খিত ট্রেন খুজে পাবেন। পরবর্তীতে বিকাশ, রকেট বা অনলাইন ব্যাংকিং পেমেন্টের মাধ্যমে সহজেই টিকিট কেটে নিতে পারবেন।

আর দেরি কেন? এখনই কেটে ফেলুন!

সিলেট টু জাফলং

টাকা খরচে মিতব্যয়ী হলে সিলেট থেকে যাবার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো লোকাল বাসে যাওয়া।

লোকাল বাসে করে যেতে হলে আপনি সিলেট শহরের শিবগঞ্জে আসুন। শিবগঞ্জ থেকে লোকাল বাসে জাফলং পর্যন্ত বাস ভাড়া ৮০ টাকা। বাসগুলো ঘন্টায় ঘন্টায় শিবগঞ্জ থেকে জাফলং এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।

মাইক্রোবাসেও যেতে পারবেন। তবে রিজার্ভ করে নিতে হবে। আপ-ডাউন ভাড়া পড়বে ৩০০০-৫০০০ টাকা। মাইক্রোবাস নিলে সুবিধা হলো যাবার পথে যতগুলো বেড়ানোর জায়গা আছে, সবখানে বিরতি নিয়ে ঘুরে দেখতে পারবেন। পরিবারের সাথে বা দলবেধে অনেকে একসাথে ঘুরতে গেলে মাইক্রোবাস নেওয়াই শ্রেয়। মাইক্রোবাস নিতে চাইলে বাস স্টপেজ থেকেই পাবেন বা শহরের যেকোনো স্ট্যন্ডেই পাবেন যদি শিবগঞ্জ যেতে না চান।

হ্যা। আরেকটা উপায়েও যেতে পারবেন! ১০০০-১২০০ টাকা সিএনজি, লেগুনা ও অটোভাড়া করে সিলেট শহরের যেকোনো সিএনজি বা অটো স্ট্যান্ড থেকে জাফলং যাওয়া যায়।

সময়ঃ মাইক্রোবাস, অটো, লেগুনা অথবা সিএনজি করে যেতে ১.৩০-২.০০ ঘন্টা সময় লাগবে।

দেশের অন্যান্য প্রান্ত থেকে জাফলং কিভাবে যাব?

আরেহ ভাই, এটা কোনো প্রশ্ন করলেন? বাংলাদেশের এহেন কোনো জেলা আছে, যেখান থেকে পীর-আউলিয়ার শহরে যাওয়া যায়না? হয় বাসে, ট্রেনে অথবা লঞ্চযোগে সিলেট যাবার যানবাহন পেয়ে যাবেন। বাস কাউন্টার অথবা রেলস্টেশনে গিয়ে একটু ঢু দিয়ে আসেন। আর এয়ারপোর্ট থাকলে তো হইছেই।

তবুও আমি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকে কিভাবে সিলেট যাবেন তা বলে দিচ্ছি।

চট্রগ্রাম থেকে সিলেট

বার আউলিয়ার দেশ থেকে শাহজালাল-শাহপরানের দেশে বাস, ট্রেন এমনকি প্লেনে করেও যেতে পারবেন।

যশোর থেকে সিলেট

খুলনা বিভাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র শহর যশোর থেকে সিলেটে সড়ক, ট্রেন ও আকাশ পথে খুব সহজেই যেতে পারবেন। যশোর থেকে সড়ক পথে বাসে করে সরাসরি যেতে পারবেন। মামুন ট্রাভেলস, হানিফ পরিবহন সহ প্রভৃতি বাসে করে ঝামেলাহীনভাবে সরাসরি সিলেট যেতে পারবেন।

জাফলং এ গিয়ে কোথায় থাকবেন?

জাফলংয়ে থাকার জন্য অনেকগুলি গেস্ট হাউজ ও রেস্ট হাউজ গড়ে উঠেছে; এছাড়া রয়েছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। তবে ভাল মানের কোনো হোটেল এখানে নেই। এগুলো আবার বেশিরভাগ সময়ই আগে থেকে বুক হয়ে থাকে, বিধায় জাফলং গিয়ে থাকতে হলে যাবার আগে বুকিং দিয়ে যেতে হবে।

আপনার সুবিধারথে আমি গেস্ট হাউজ ও রেস্ট হাউজের যোগাযোগ করার ঠিকানা নিচে সন্নিবেশ করছি।

  • জেলা পরিষদের রেস্ট হাউজ। যোগাযোগঃ ইউ.এন.ও- +৮৮০১৭৩০-৩৩১০৩৬ । কেয়ারটেকার- +৮৮০১৭৫২-২২৬৩৭৫
  • সওজ বাংলো। যোগাযোগ- নির্বাহী প্রকৌশলী, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সিলেট- +৮৮০১৭৩০-৭৮২৬৬২
  • নলজুরি রেস্ট হাউজ, নলজুরি। যোগাযোগঃ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, সিলেট- +৮৮০১৭১১-৯৬৬০১৯ । কেয়ারটেকারঃ +৮৮০১৭৫২-২২৬৩৭৫
  • গ্রীণ পার্ক রেস্ট হাউজ, নলজুরি। যোগাযোগ- বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, সিলেট। ফোন- +৮৮০১৭১১-১৮০৫৭৪। কেয়ারটেকারঃ ০১৭৬৬-৮৫৭১৬৮

রেফারেন্সঃ জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও নিজ অভিজ্ঞতা।

জাফলং এর হোটেলগুলি আমার পছন্দ না হলে কি করব?

আরে মুসিবৎ!
না ভাই। রেস্টহাউজগুলো পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক।

তাহলে?

সিলেট যেয়ে আবার থাকার চিন্তা। বাংলাদেশের লন্ডন বলে খ্যাত এ শহরে রয়েছে থাকার জন্য উন্নতমানের অনেকগুলি হোটেল।
আপনার সুবিধার্থে এখানে সিলেট শহরের মানসম্মত কতকগুলি হোটেলের নাম বলে দিচ্ছি।

নিচে সন্নিবেশিত হোটেলগুলি সিলেট শহরের জিন্দাবাজার, আম্বরখানা এবং মাজার রোডে অবস্থিত।

  • হোটেল গুলশান
  • হোটেল ইস্টার্ন গেইট এন্ড পানাহার রেস্টুরেন্ট
  • হোটেল বাহারাইন রেসিডেন্সিয়াল
  • হোটেল দরগা ভিউ
  • হোটেল আজমীর
  • হোটেল পায়রা
  • হোটেল সিল্ক সিটি ইন্টাঃ
  • গ্রীনল্যান্ড হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট
  • হোটেল সুপ্রিম
  • হোটেল ওয়েস্টার্ন
  • হোটেল স্টার প্যাসিফিক
  • হোটেল পানামা
  • হোটেল হিলটাউন
  • হোটেল রোজভিউ
  • হোটেল গার্ডেনস ইন
  • হোটেল কুরাইশি রেস্টুরেন্ট
  • হোটেল অনুরাগ
  • হোটেল আল-আমিন
  • হোটেল ফেরদৌস
  • হোটেল তাজমহল
  • সুরমা ভ্যালি রেস্ট হাউজ

জাফলং ভ্রমণে গিয়ে কম খরচে কোথায় থাকা যায়?

সিলেট শহরের লালাখাল এলাকা, দরগা রোডে কম খরচে বিভিন্ন হোটেলে থাকতে পারবেন। এখানে হোটেলভেদে ৫০০-৩০০০ টাকা ভাড়ায় থাকতে পারবেন।

কোথায় খাবেন?

জাফলং দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসলে আমার পরামর্শ হবে সিলেট শহর থেকে খাবার কিনে নিয়ে যাওয়া। যদিও যে রেস্তোরাগুলো রয়েছে তা একেবারে খারা[প না!

তবে দামে ও মানে উভয়েই পরিতুস্ট থাকতে চান তবে আমার পরামর্শ অনুসরন করতে পারেন।

জাফলং ভ্রমনের উপযুক্ত সময় কখন?

প্রকৃতিকন্যা ঋতুভেদে নানান রুপের মহিমা দেখায়। শীতে জাফলং এর এক রুপ, আবার বর্ষাকালে আরেকরূপ। প্রকৃতি যেন প্রকৃতিকন্যাকে আপন মহিমায় বিভিন্ন ঋতুতে বিচিত্রভাবে সাজায়। হ্যাঁ। প্রকৃতিকন্যা বলে কথা; বিচিত্র সৌন্দরয ধারন করা তো তাকেই মানায়।

তবে প্রকৃতি জাফলং কে যেন, বর্ষাকালেই সাজাতে বেশি ভালবাসে। প্রকৃতিকন্যার রুপ বর্ষাকালে যেন উপচে পড়া পানির মতোই ফুলে ফেপে ওঠে। এ সময় সে সৌন্দর্যের যৌবন ফিরে পায়।

বর্ষাকালে ঝর্ণাগুলিতে প্রানে পানি সংহার হয়, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ তোয়া জল যেন দিগ্বিদিক তার সৌন্দরযের আবেদন ছড়িয়ে দেয়। সাদা পাথর আর মন ভোলানো স্বচ্ছ জলের মিতালী যেন সৌন্দরযের প্রস্তরে তীব্র হাহাকার জন্ম দেয়।

প্রকৃতিকন্যকে স্বরুপ ও আপন মহিমায় দেখার জন্য অবশ্যই বর্ষাকালে যাওয়া উচিৎ।

জাফলং এর দর্শনীয় স্থানঃ কি কি দেখবেন?

বড় করে শ্বাস নিয়ে নিন। ডিসট্রাকশনগুলোকে আপাতত সযত্নে পাশে সরিয়ে রাখুন।

আর দেরি কেন! এবার শুরু করা যাক!

জাফলং জিরো পয়েন্ট

jaflong zero point

প্রকৃতিকন্যা জাফলং এ কি নেই দেখার?

সে তো তার রুপের পসরা নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার রুপের ভক্তের জন্যে।

পাহাড়ের মায়াময় আচ্ছাদন, পাহাড়ের উপর থেকে ওপারের ডাউকি শহরের মিটমিট আলোয় শোভিত নন্দন কাননের প্রতিচ্ছবি, পাহাড়ি ঝরনার ঢল থেকে প্রবাহমান পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জল, মন উদাস করে দেওয়া সাদা পাথর, পিয়াইন নদীর উপরে দোলুল্যমান ভাসমান ব্রিজ, দুইধারে পাহাড়- মাঝখান দিয়ে প্রবাহমান নদী আর এরসাথে পাহাড়, পাথর, নদীকে একাকার করে দেওয়া দিগন্তজোড়া নীলাভ আকাশ; এ সৌন্দরযপুরী যেন কল্পনালোককেও অতিক্রম করে। সেইসাথে ধলাই ও পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলে জলকেলি করে বেড়ানো সুদর্শনা মাছের সুস্পষ্ট দর্শন যেন এসব কিছুকে পূর্ণতা দেয়।

জাফলং
জিরো পয়েন্ট

জাফলং জিরো পয়েন্টের কথা বলছিলাম। কিন্তু শুধুই কি জিরো পয়েন্ট? মোটেও না। প্রকৃতির কন্যাকে দেখতে এসে আপনি উপহারস্বরুপ আরও কিছু দর্শণীয় স্থান ঘুরে দেখার সু্যোগ পাবেন। আমি সেসব জায়গাগুলির কথা আপনার সুবিধার কথা ভেবে আলাদাভাবে তুলে ধরছি যাতে করে আপনি জাফলং ভ্রমনে গিয়ে সবটুকু মজা উপভোগ করতে পারেন।

জাফলং
জাফলং জিরো পয়েন্টের অদূরে

খাসিয়া পল্লী

জাফলং জিরো পয়েন্টের সন্নিকটেই গড়ে উঠেছে খাসিয়া উপজাতিদের গ্রাম সংগ্রামপুঞ্জি। প্রকৃতি দর্শন করতে গিয়ে যদি উপজাতিদের আদীম জীবনধারা দেখে আসা যায়, তবে মন্দ কি!

ধলাই নদী পার হয়ে জেগে ওঠা চর পার হলেই দেখা মিলবে খাসিয়া পল্লী। খাসিয়া বাড়িগুলো দেখতে বেশ আলাদা। প্রতিটি বাড়িই মাটি থেকে ৩-৪ ফুট উচুতে নির্মিত।

সেইসাথে বাড়িগুলোর সাথে রয়েছে পানের বরজ। মজার না! তবে খাসিয়া রমণীদের পান বরজ থেকে পান পাতা সংগ্রহ এবং ভাজ করে খাচা ভর্তি করার অভিনব দৃশ্য় পর্যটককে যেন বিমোহিত করে ফেলে। মাতৃতাত্বিক খাসিয়া পরিবারের জীবনপ্রবাহ কাছ থেকে দেখার বিরল দৃশ্য দেখার জন্য হলেও একবার খাসিয়া পল্লীতে ঘুরে আসবেন।

খাসিয়া রাজার বাড়ি

রাজবাড়ি! হ্যাঁ। খাসিয়া রাজার বাড়ি। খুব সুনসান রাজবাড়ির মতো দেখতে না হলেও যথেষট সুন্দর।

খাসিয়া পল্লীর কমলা বাগান

কমলা বাগান! তাও আবার বাংলাদেশে! যেখানে কমলা লাগানোর পরে সে কমলা বাঘের পশ্চাৎদেশে লাগালে সেও পাগলা কুত্তার মতো একটা দৌড় দিবে ?

হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। সুমিষ্ট কমলার বাগানের দেখা মিলবে, জাফলঙের খাসিয়া পল্লীতে।

কল্পনা করুন তো, থোকায় থোকায় সাজানো রাঙা কমলা দেশের মাটিতে দেখতে কেমন লাগবে?

কমেন্ট করে বলে যায়েন, ভাল লাগবে।

সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা

এডভেঞ্চার প্রেমিক মানুষের কাছে সুপরিচিত সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্নার আরেক নাম মায়াবীনি ঝর্না। এই নামই বলে দেয় তার রুপের কদর্যের কথা। তিন স্তরে বিভক্ত এই ঝর্নাটি পড়েছে ভারতের অংশে; পিয়াইন ন্দীর ওপারে। পিচ্ছিল পাথর আর সুড়ঙ্গের রহস্যাবৃত এই ঝর্না চড়তে তাই সাহসী পর্যটক হওয়া বাঞ্চনীয়।

বিএসএফ এর প্রহরায় বাংলাদেশের পর্যটকেরা ঝর্নাটি ঘুরে দেখার সুযোগ পায়। জিরো পয়েন্ট থেকে ১৫-২০ টাকা ভাড়ায় নৌকায় চড়ে এই মায়াবিনী ঝর্নায় যাওয়া যায়।

তবে শীতের মৌসুমে ঝর্নায় পানি কমে যাওয়াই তা ভ্রমন উপযোগী থাকেনা। তাই সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্না উপভোগ করতে হলে বর্ষার মৌসুমে যেতে হবে। আবার বলছি, ঝর্না দেখার ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই অবশ্যই বর্ষাকালে যাবেন, ২০২০ এ আমি নিজে গ্রীস্মের শুরুতে গিয়ে ঝর্নার অশ্রু দিয়ে জল বের হতে দেখিনি ?

চা-বাগান

জাফলং চা বাগান
খাসিয়া পল্লীর চা বাগান

সিলেট যাবেন চা-বাগান দেখবেন না, তা তো হয় না। তবে অনেকেই বলবেন যে সিলেটের চা-বাগান মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গলের মতো সুন্দর না। হ্যাঁ, ভাই আমিও সেটা মানছি। কিন্তু সিলেট তো আপনি চা-বাগান দেখার মুখ্য উদ্দেশ্যে যান না, তাহলে চা-বাগান ঘুরে দেখলে ক্ষতি কি- এবার সেটা যেমনই হোক। এইটারে বোনাস হিসাবে নেন,ভাইজান।

আচ্ছা,বহুত মোটিভেশন দিলাম, আসল কথায় আসি। খাসিয়া পল্লীতে একটা সুন্দর ছোটখাট চা-বাগান দেখতে পাবেন। আগে যারা চা-বাগান দেখেননি তারা ডেফিনেটলি ঘুরে দেখতে পারেন। খারাপ না।

জাফলং এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

আসুন একটু ইতিহাসও পড়ে যান।

পূর্বে জাফলং ছিল এক নির্জন বনভুমি। তখন থেকেই এখানে খাসিয়া ও জৈন্তা উপজাতিদের বসতি। খাসিয়া-জৈন্তা রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত এ অরন্যভুমিতে বহুকাল ধরে বহু খাসিয়া-জৈন্তা রাজপরিবার রাজত্ব করে গেছেন। জমিদারি প্রথা বিলোপের মধ্য দিয়ে ১৯৫৪ সালে খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটে। তখন থেকে এ বিরানভূমি স্টেটের খাস বনভুমির অন্তর্ভুক্তি হয়। এর ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাথর ব্যাবসায়ীরা আসার সুযোগ পায়। পাথর ব্যবসাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বসতি, ক্রমেই সেই বসতি জনবসতির রুপান্তর ঘটায়।

ভ্রমনচারী টীপস

  • জিরো পয়েন্টের একদম সন্নিকটে ইন্ডিয়ান বর্ডার, তাই সতর্ক থাকা উচিত।
  • সিলেট(শিবগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড) থেকে জাফলংগামী লোকাল বাসগুলি ১ ঘণ্টা পর পর ছেড়ে যায়। তাই বাড়তি সময় হাতে নিয়ে বের হবেন, ইন কেইজ বাস মিস হয়, তাহলে ১ ঘন্টার কালক্ষেপন সহ্য করা লাগবে।
  • জাফলং এ আপনার মনের মত মানসম্মত খাবার নাও পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে সিলেট থেকে কিনে নিয়ে যেতে পারেন।

ইতিকথা

জাফলং তার আপন সৌন্দর্যের মহিমায় মহিমান্বিত। প্রতিনিয়ত সে তার জ্বালাময়ী রুপ দিয়ে তার ভক্তদের দগ্ধ করে চলেছে। হে প্রকৃতিপ্রেমিক! হে স্রষ্টার অসীম সৌন্দর্যের গুনাগ্রাহী ! প্রকৃতি কন্যা যে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। রূপের মহিমা প্রকাশে উন্মুখ সে কন্যাকে একবার দর্শন করে তার ব্যথা দূর করে আসুন।

বার বার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমুহ

জাফলং কোন জেলায় অবস্থিত?

সিলেট জেলায়।

সিলেট থেকে জাফলং কিভাবে যাবেন?

লোকাল বাসে করে যেতে হলে সিলেট শহরের শিবগঞ্জে আসুন। শিবগঞ্জ থেকে লোকাল বাসে জাফলং পর্যন্ত বাস ভাড়া ৮০ টাকা। বাসগুলো ঘন্টায় ঘন্টায় শিবগঞ্জ থেকে জাফলং ছেড়ে যায়। মাইক্রোবাসেও যেতে পারবেন।

তবে রিজার্ভ করে নিতে হবে। আপ-ডাউন ভাড়া পড়বে ৩০০০-৫০০০ টাকা। আরেকটা উপায়েও যেতে পারবেন জাফলং। ১০০০-১২০০ টাকা সিএনজি, লেগুনা ও অটোভাড়া করে সিলেট শহরের যেকোনো সিএনজি বা অটো স্ট্যান্ড থেকে জাফলং যাওয়া যায়।

জাফলং কোন নদীর তীরে অবস্থিত?

পিয়াইন নদীর তীরে।

জাফলং কি নামে পরিচিত?

জাফলং কে প্রকৃতিকন্যা নামে অভিহিত করা হয়।

ভ্রমণ, লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় আসক্ত। কাচ্চির আলু আর দুধ খেজুরে পিঠার পাগল। নিজের ভ্রমণ গল্পগুলো লিখি এখানে। ফেসবুক, টুইটারে আমাকে অনুসরন করতে পারেন!

Twitter | Facebook

মন্তব্য করুন