বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরঃ ঘুরতে যাবার দাবি রাখে? (রিভিউ+ভ্রমণগাইড)

বিজয় সরণি থেকে হাটছিলাম চন্দ্রিমা উদ্যান তথা সংসদ ভবন বাইপাস সড়কের নাক বরাবর। এই সড়কটুকু সত্যিই সুন্দর। দুইপাশে সবুজ গাছপালা; পাতাগুলোও ছাটাই করা, লেনের দুইপাশে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে সবুজ ঘাসের গালিচা। সেই সাথে সন্ধার আবছা আলোয় সারিসারি নিয়ন বাতির হলদে আভা আর ঝিরঝিরে শীতল হাওয়া।

এমন সময় ঠিক সামনে দিয়ে উঠতি বয়সী এক তরূনী হেটে যাচ্ছিল। বয়স কত হবে আর এই ১৫-১৬। তবে এক ঝলকের দেখায় গড়নের চেহারা দেখে সে বয়স বোঝার উপায় ছিল না। হাই হিল পরে খটখট শব্দ করে হাটতে থাকা মেয়েটির দিকে কেন যেন হঠাৎ করেই চোখ পড়ে গেল।

বামপাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিল সে।

ঠিক তখনই…

তাকাতেই মুহূর্তের পলকে যেন মিলিয়ে গেল মেয়েটি! 😔

উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে বিক্ষিপ্তভাবে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে আচমকা দেখতে পেলাম উজ্জ্বল ক্রিসেন্ট গ্লাসে ঢাকা মস্ত বড় এক ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ড।

লেখা বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর (samorik jadughar) 😂😊।

কৌতুক পাশে রাখে মোদ্দা কথার ঝুড়ি হাতে-

চলুন বিস্তারিত শুরু করা যাক!

সামরিক জাদুঘর কোথায় অবস্থিত?

বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের অবস্থান ঢাকার প্রানকেন্দ্র বিজয় সরণি অদূরে। বিজয় সরণি মোড় থেকে সংসদ ভবন বাইপাস সড়কের দিকে একটুখানি এগিয়ে সামনে। আর নভোথিয়েটার থেকে পশ্চিমে কয়েক পা এগিয়ে।

সামরিক জাদুঘর কিভাবে যাব?

সোজা বিজয় সরণি চলে আসুন। বিজয় সরণি ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে বাসে করে আসতে পারবেন। সব বাসই বিজয় সারণী দাড়ায়।

কোনোভাবে যদি বিজয় সরণি চিনতে অসুবিধা হয় তবে আগে ফার্মগেট আসুন। ফার্মগেট অবশ্যই চেনার কথা। ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণি চিনতে অসুবিধা হবেনা। বিজয় সরণি মোড়ের একদম পাশেই নভোথিয়েটার। আর আগেই বলেছি নভোথিয়েটার থেকে কয়েক কদম আগে বাড়লেই পেয়ে যাবেন বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর।

সামরিক জাদুঘর প্রবেশ টিকিট মূল্যঃ অনেক বেশি ?

সামরিক জাদুঘর সর্বসাধারনের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশের জন্য় উন্মুক্ত ছিল পূর্বে। বর্তমানে টিকেট মূল্য ৫০ টাকা।

সামরিক জাদুঘরের আপাদমস্তক [যা যা দেখবেন]

samorik jadughor
সাজিয়ে রাখা নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ

চলুন, সামরিক জাদুঘরের ভেতর বাহিরে শব্দ শব্দে ঘুরে আসি। আচ্ছা, এটাকে তাহলে কি বলা যায়? শব্দভ্রমন!

বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরের প্রধান ভবনের ২য় তলায় ৮ টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে। তার মধ্যে ৪ টি প্যাভিলিয়ন মধ্যযুগের অস্ত্রশস্ত্র থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের নানান মারণাস্ত্র। আদীম যুগের তীর থেকে শুরু করে আধুনিক বিধ্বংসী সব অস্ত্রশস্ত্রের দেখা মিলবে এখানে। এছাড়া জাদুঘরের এই প্যাভিলিয়নে আরও রয়েছে খ্যাতনামা বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ব্যাবহৃত অস্ত্রশস্ত্র।

এর ভিতরে ১ম গ্যালারিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রাচীন যুদ্ধাস্ত্র যেমন তরবারি, হাত কুঠার, ঢাল, তীর ধনুক ইত্যাদি। ২য় গ্যালারীতে খ্যাতনামা যোদ্ধাদের যুদ্ধাস্ত্র। আর তৃতীয়টাই রয়েছে মাঝারী মানের কিছু অস্ত্র-সরঞ্জাম যেমন এলএমজি, এসএমজি এবং ৪র্থ গ্যালারীতে রয়েছে মর্টার, স্প্যালো, এইচএমজীসহ ভারি ভারি সব অস্ত্রশস্ত্র।

জাদুঘরের অন্য ৪ টি গ্যালারীর প্রথমটিতে রয়েছে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ঋতুকালীন সামরিক পোশাক পরিচ্ছদ, সামরিক র‍্যাঙ্ক, ব্যাচ, ল্যাচ প্রভৃতি। ২য় গ্যালারীতে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি বিজড়িত উপকরনসমূহ। এজন্য গ্যালারীটির নাম দেয়া হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের পোট্টেট সংবলিত জীবনবৃত্তান্ত প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে।

অপর চারটি গ্যালারীর মধ্য ‘বিজয়’ শীর্ষক  ৩ নং গ্যালারীতে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠদের পোট্টেট ও জীবন প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও এম এ জি ওসমানির ব্যাবহত জিপ গাড়ি

আর সর্বশেষ গ্যালারীটিতে রয়েছে প্রাক্তন সকল সেনাপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীরদের নাম সংবলিত নামফলক।

জাদুঘরটির অন্যতম আকর্ষণ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ও এম এ জি ওসমানির ব্যাবহৃত ‘জিপ গাড়ি’। এই জীপ গাড়িতেই চেপেই জেনারেল ওসমানী যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করতেন। জাদুঘরের নিচ তলায় দেখা যাবে এটি।

Bangladesh Military Museum
কামান

নীচ তলার পশ্চিম পাশে রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’। পশ্চিম পাশের কোনার একটি কক্ষে এটি স্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্মৃতি বিজড়িত নানান আলোকচিত্র নিয়ে এই কর্নারটি  সাজানো হয়েছে।

এছাড়া মিলিটারী মিউজিয়ামের মাঠজুড়ে রয়েছে নৌবাহিনীর বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজ, সাজোয়া যান, ট্যাংক ও কামান।

বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরের গোড়াপত্তন

সময়টা ১৯৮৭ যখন ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসের প্রবেশমুখে সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি সামরিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত মুক্তিবাহিনী যা কিনা আজকের আধুনিক সশস্ত্র। সেই মুক্তিবাহিনীর স্মৃতি, সাফল্য, সাহসীকতা, গৌরবগাথা আর এখনকার আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর সৌকর্য, বীরত্ব ও সক্ষমতাকে জনগনকে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়াসে গঠিত হয় বাংলাদেশ সামরিক জাদঘর।

তবে ১৯৯৯ সালে অবকাঠামো, অবস্থান ও সংকুলানগত কারনে জাদুঘরটিকে স্থায়ীভাবে ঢাকার বিজয় সারণিতে স্থানান্তর করে আনা হয়।

পুরো নির্মানযজ্ঞ শেষে ২০০৪ সালে জাদুঘরটি সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর নাকি বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর

আসলে কি?

বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর না ঢাকা সামরিক জাদুঘর? নাকি বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর?

শুদ্ধ উত্তর হলো বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর। কেন?

২০১৯ সাল পর্যন্ত জাদুঘরটি বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর বলেই পরিচিত ছিল। তবে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে জাদুঘরটির নাম বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর রাখার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।

সামরিক জাদুঘর সময়সূচী
সামরিক জাদুঘরের নবনির্মিতব্য অত্যাধুনিক মাল্টিপারপাস ভবন

এর পূর্বে সামরিক জাদুঘর উন্নয়নে বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর আলোকে শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রকল্পের অধীনে সামরিক জাদুঘর আধুনিকায়নে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর বিশাল এক জাদুঘর কমপ্লেক্স নির্মান কাজ হাতে নেওয়া হয়।

সামরিক জাদুঘর সময়সূচি

সবসময় মিলিটারি মিউজিয়ামের শো-ওপেন নাও থাকতে পারে। তাই কখন কখন জাদুঘর খোলা থাকে- যাবার আগে তা জানা অত্যাবশ্যক।

বারসময়সূচী [গ্রীষ্মকাল]সময়সূচী [শীতকাল]
শনিবারসকাল ১০.৩০ থেকে সন্ধা ৬.৩০সকাল ১০ টা থেকে সন্ধা ৬ টা
রবিবারসকাল ১০.৩০ থেকে সন্ধা ৬.৩০সকাল ১০ টা থেকে সন্ধা ৬ টা
সোমবারসকাল ১০.৩০ থেকে সন্ধা ৬.৩০সকাল ১০ টা থেকে সন্ধা ৬ টা
মঙ্গলবারসকাল ১০.৩০ থেকে সন্ধা ৬.৩০সকাল ১০ টা থেকে সন্ধা ৬ টা
বৃহস্পতিবারসকাল ১০.৩০ থেকে সন্ধা ৬.৩০সকাল ১০ টা থেকে সন্ধা ৬ টা
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের সময়সূচী

সামরিক জাদুঘর বন্ধের দিন?

বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর বুধবার ও শুক্রবার বন্ধ থাকে।

আচ্ছা আমি তো ঢাকায় থাকি না তাহলে কোথায় থাকব?

শোনেন বিজয় সারণির আশেপাশেই ভালো মানের কয়েকটা আবাসিক হোটেল রয়েছে। তাই কোথায় থাকবেন তা নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। তবে হোটেলগুলি ৫ তারকা মানের নয়। আপনি নিজেই যাচাই বাছাই করে ভাড়া ঠিক করে নিতে পারবেন।

তবে ফার্মগেটে কোনো হোটেলে থাকতে চাইলে অবশ্যই ভেবে চিন্তে, পরিচিত কারও পরামর্শ নিয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সামরিক জাদুঘর

সামরিক জাদুঘর ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কেনই বা না?

জাদুঘরটি তো সেনাবাহিনীকে তুলে ধরতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

তাই, সামরিক জাদুঘরের সব ধরনের কার্যক্রম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালনা করে থাকে। জাদুঘরের উন্নয়ন ও রক্ষনাবেকক্ষনের ভারও সেনাবাহিনীর উপর ন্যস্ত।

যে ৪ টি কারনে সামরিক জাদুঘর ঘুরে দেখা উচিত

  • আমাদের মাতৃভুমির সার্ভভৌমতা অক্ষুন্ন রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্ষমতা অনুমান করতে পারবেন।
  • আমাদের সেনাবাহিনীর গৌরব ও বিরত্বগাঁথা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
  • আধুনিক সব সমরাস্ত্র দর্শন ও এ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।
  • মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যাবহৃত অস্ত্র-সরঞ্জাম দেখতে পারবেন।

আশেপাশে আর কোথায় ঘুরতে পারেন?

সামরিক জাদুঘরের একদম পাশেই রয়েছে মাওলানা ভাসানী নভোথিয়েটার। একদম প্রতিবেশির মতো। সময় থাকলে নভোথিয়েটারটাও দেখে আসতে পারেন। চন্দ্রিমা উদ্যানও কিন্তু একদম নিকটেই। আর কাছাকাছি ঘুরে দেখার মত স্থান হলো বিমান বাহিনী জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও হাতিরঝিল।

ভ্রমণচারী টিপস: যদি মিলিটারি মিউজিয়াম ঘুরতে যাবার প্লান করেন তবে একইসাথে মিলিটারি মিউজিয়াম এবং নভোথিয়েটার ঘুরে আসায় শ্রেয় কেননা এতে করে আলাদা আলাদা করে ঘুরতে যাবার অর্থ ও সময় উভয়ই বাঁচবে।

আচ্ছা ঘুরতে তো অনেকক্ষন লাগবে, খাব কোথায় 😟?

আহ! খাবার।

অন্তত বিজয় সারণীতে খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা ভাই। পুরো বিজয় সারণীজুড়েই মধ্যম মান থেকে উন্নত মানের একগাদা রেস্টুরন্ট।

তবে সবচেয়ে দারুন ব্যপার হলো সামরিক জাদুঘরের মধ্যে নামকরা একটি রেস্টুরেন্ট কাম পার্টি সেন্টার রয়েছে।

তবে হতাশাকর একটি বিষয়ও রয়েছে। অনুমান করুন তো!

ঠিক বিজয় সারণী বা জাদুঘরের ভেতরকার রেস্টুরেন্ট- সবখানেই মূল্য একটূ চড়া। তবে সীমার বাইরে না। এই আপনার খরচ একটু বেশি হবে এই যা আরকি 😛।

তবে তা নিয়ে চিন্তা করবেন না , চাইলে বাসা থেকে রান্না করেও নিয়ে যাইতে পারেন 😉 যদি তা আপনার পছন্দ হয়।

আপনার উদ্দেশ্যে

আপনি সমরপ্রিয় হোন বা না হোন আপনার সামরিক জাদুঘর ঘুরে আসা উচিত। এতে করে যেমন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর গর্বিত ইতিহাস এবং তাদের অর্জন ও সক্ষমতা জানতে পারবেন তেমনি তা আপনাকে দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলবে।

এসব দিক বিবেচনায় আনলে সামরিক জাদুঘর একবার হলেও ঘোরার দাবি রাখে।

এখন আপনার কাছে আমার একটি প্রশ্ন আপনি কোন নামটি বেশি পছন্দ করেন? বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর নাকি বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর। নিচে কমেন্ট করে জানান।

বারবার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহ

সামরিক জাদুঘর কোথায়?

ঢাকার প্রানকেন্দ্র বিজয় সরণিতে অবস্থিত।

সামরিক জাদুঘরের নতুন নাম কি?

বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর।

রেফারেন্স

ভ্রমণ, লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় আসক্ত। কাচ্চির আলু আর দুধ খেজুরে পিঠার পাগল। নিজের ভ্রমণ গল্পগুলো লিখি এখানে। ফেসবুক, টুইটারে আমাকে অনুসরন করতে পারেন!

Twitter | Facebook

“বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরঃ ঘুরতে যাবার দাবি রাখে? (রিভিউ+ভ্রমণগাইড)”-এ 1-টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন