আমরা সবাই কমবেশি চা পান করি। কিন্তু, কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আমরা যে চা পান করি; তা মাত্র এক লেয়ারের?
আমরা সবাই চা পান করি বটে, তবে এ নিয়ে কখনও সচেতনভাবে চিন্তা করিনা।
এই মুহুর্তে, আপনি হয়ত ভাবছেন, “আচ্ছা, বহু লেয়ার বিশিষ্ট চা হয়?”।
জি! বহু লেয়ার বলতে ৭ লেয়ার বিশিষ্ট চা পর্যন্ত হয় (কমপক্ষে, আমরা যতদূর জানি)! অর্থাৎ, আপনি সচারচর যে এক কাপ চা পান করেন, সেখানে রীতিমতো সাত-সাতটা লেয়ার থাকবে!ca
“বাপরে বাপ”!
দাঁড়ান ভাইয়া! ৭ লেয়ারের এই চা আপনি আপনার আশেপাশের টঙের দোকানে পাবেন না, কিন্তু।
“তাহলে, সাত রঙের চা কোথায় পাওয়া যায়?”
উত্তর, নীলকন্ঠ চা কেবিন শ্রীমঙ্গল।
আর আজকে পুরো লেখায় আমি আপনাকে জানাব-
আপনি যদি এসবে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে শু্রু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
নীলকন্ঠ চা কেবিন এর ইতিহাস
নীলকন্ঠ চা কেবিনের ইতিহাসটা বেশ চমৎকার।
সাত লেয়ারের চা আবিষ্কার কর্তার নাম রমেশ রাম গোর । উনার বর্তমান বয়স ৪২ বছর।
তার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায়।
তার মুখ থেকে শোনা যায় যে, তিনি সেখানকার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে, পুরো ব্যবসায়ের মালিকানা তার ছিল না, ছিলেন অংশীদার।
এমতাবস্থায়, ব্যবসাতে তিনি আশানুরুপ ভাল করতে পারেননি। ভাগ্যের আশায় পাড়ি জমান শ্রীমঙ্গলে।
বলছি, প্রায় আজ থেকে ২০ থেকে ২২ বছর আগের কথা।
মাত্র ১৫০০ টাকা নিয়ে তার পুত্র,কন্যা, স্ত্রী’কে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। তারপর বাসা ভাড়া নেন রামনগর মনিপুরিপাড়ায়। শুরুতে সেখানে একটি চাকুরী খুঁজে নেন। কিন্ত, সেই চাকুরী তার বেশী দিন করা হয়ে ওঠেনি।
মনে মনে ভাবলেন, চায়ের দেশে আছি তাহলে সেখানে একটি চায়ের দোকান দিলে কেমন হয়!
সেই ভাবনা থেকেই তিনি প্রথম চায়ের দোকান দেন চা গবেষনা ইন্সটিটিউট এর সামনে। এভাবে সময় কেটে যেতে লাগলো। পরিপেক্ষিতে অনেক চিন্তাভাবনা করে তিনি প্রথম আবিষ্কার করে ফেললেন একই কাপে দুই লেয়ারের চা।
সেই একই কাপে দুই লেয়ারের চা আবিষ্কার করার পর চারদিকে উনার নাম গুনাগুন ছড়িয়ে গেল বাতাসের বেগে।
এক এক করে তিনি এক কাপে তিন লেয়ার, চার লেয়ার,পাঁচ লেয়ার, ছয় লেয়ার, সাত লেয়ার এমনকি আট লেয়ারের চা বানাতেও সক্ষম হন!
পুরো বাংলাদেশ জুড়ে তো বটেই, বড় বড় বিদেশী ম্যাগাজিনও তার আবিস্কার ফলাও করে প্রকাশ করে।সাত লেয়ারের চা আবিষ্কারক হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি পায় রমেশ রাম গোড়।
বর্তমানে এই নীল কন্ঠ চা কেবিন এর দুইটি শাখা রয়েছে । শ্রীমঙ্গলের মনিপুরী অধ্যুষিত রামনগড়ে একটি এবং অপরটি কালিঘাট রোডের ১৪ রাইফেল ব্যাটালিয়া্ন ক্যান্টিনে।
নীলকন্ঠ চা কেবিনের বিভিন্ন লেয়ার বিশিষ্ট চায়ের দাম

আপনি শ্রীমঙ্গলে যাবেন কিন্তু, নীলকন্ঠ চা কেবিনে বসে সাত লেয়ারের চা পান করবেন না সেটা হতেই পারে নাহ!
আপনি নীলকন্ঠ টি কেবিনে বিভিন্ন ধরনের চা পেয়ে যাবেন; ১০ টাকা কাপের চা হতে শুরু করে ৯০ টাকা কাপ বিশিষ্ট চা পেয়ে যাবেন।
একইসাথে সেখানে বিভিন্ন রকমের চা ক্লোনের সাহায্যে এবং মশলার সংমিশ্রনে তৈরি স্বাদবিশিষ্ট চা পাওয়া যায়।
আপনাদের সুবিধার্থে বিভিন্ন লেয়ারের চায়ের দামের একটি তালিকা সংযুক্ত করে দিচ্ছি।
চায়ের নাম | লেয়ার সংখ্যা | দাম (টাকা) |
দুধ চা | নাই | ১০ টাকা |
লেবু চা | নাই | ১০ টাকা |
পাঁচ লেয়ারের চা | পাঁচ | ৫০ টাকা |
ছয় লেয়ারের চা | ছয় | ৬০ টাকা |
সাত লেয়ারের চা | সাত | ৭৫ টাকা |
আট লেয়ারের চা | আট | ৯০ টাকা |
সতর্কতাঃ আর হ্যাঁ, আপনাকে যেটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে সেটা হলো যে শ্রীমঙ্গল শহরে আপনি সাত বা আট লেয়ার চা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন টাইপ এর দোকান বা রেস্টুরেন্ট পাবেন যেখানে আপনি লেয়ার বিশিষ্ট চা পাবেন ।
কিন্তু কথা হচ্ছে যে, আপনি যদি আসলেই সাত বা আট লেয়ার বিশিষ্ট চা এর স্বাদ আস্বাদন করতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে রমেশ রাম বাবুর দোকানে।
মনে রাখবেন-
“আপনার দু’ পয়সা বাচাতে পারলেই ভ্রমণচারীর আসল উদ্দেশ্য সার্থক হয়”
সিলেটের সাত রঙের চা তৈরির প্রণালি
সাত লেয়ারের চা যে শুধু মাত্র সিলেটেই পাওয়া যাবে, তা কিন্তুূ নয়! নিশ্চিতভাবে, আপনি সবসময়-ই সিলেট যাবেন না। তবে, যখন যাবেন তখন কিন্তু, ভ্রমণচারীর সিলেট ভ্রমণ প্যাকেজ ছাড়া যাবেন না?
কিন্তু, এখন যদি না যেতে চান কিভাবে ঘরে বসেই ৭ রঙের চা প্রস্তুত করে ফেলা যায়, তার গোপন রহস্য উন্মোচন করব!
আসেন, কানে কানে বলি? ?
যাহোক, আপনার মনে হতে পারে, এই লেয়ার বিশিষ্ট চা বানানো নিশ্চয়ই মারাত্নক কঠিন কাজ। কিন্তু, আসলে কি তাই?
বরং…
বাসায় সাত রঙা চা বানিয়ে যে কাউকে চমকে দিতে পারবেন একদম সহজে। তাহলে চলুন দেখে নিই কিভাবে তৈরী করতে পারি লেয়ার বিশিষ্ট চা।
সিলেটের সাত রঙের চায়ের রেসিপি-
- চা পাতা
- পানি
- চিনি
- কনডেন্স মিল্ক
- কাঁচের গ্লাস (স্বচ্ছ)
- ছাঁকনি
- চামচ

চলুন চা তৈরি শুরু করা যাক!
প্রথমে একটি প্যানে জল গরম করের ফেলুন। তারপর একটি কাঁচের গ্লাসে, গ্লাস টি যেনো অবশ্যই স্বচ্ছ হয়, কেননা স্বচ্ছ না হলে লেয়ারটি ভালভাবে বোঝা যাবে না।তারপর একটি গ্লাসে আপনি আপনার পরিমাণ মত চিনি নিয়ে নিন।
তারপর, গরম গরম করা পানিটি গ্লাসে ঢেলে দিন। একটি চামচ দিয়ে চিনি সহ পানি দিয়ে নেড়ে দিন ।কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে চিনি যেন পুরোপুরি পানিতে না মিশে যায়। অর্থাৎ, হাল্কা করে চামচ দিয়ে নেড়ে নিন।
তারপর, প্যানে রাখা বাকি পানি আছে সেটাতে আপনি পরিমাণ মত চা পাতা দিয়ে দিন।এরপরে ভালো করে মিস্ক করে নিন । প্রায় ৫ থেকে ১০ মিনিট ধরে চা পাতাটিকে ফুটিয়ে নিবেন।চা পাতার মিশ্রন টি যেন একটু ঘন হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
ঘন হওয়ার পর অন্য একটি পাত্রে আপনি ঘন চা পাতার মিশ্রণটিকে ছেঁকে নিন।তারপরে একটি চামচ দিয়ে আস্তে আস্তে স্বচ্ছ চিনি মিশ্রিত পাত্রটিতে ঘন চা প[তার মিশ্রণটি ঢেলে দিন। অবশ্যই আস্তে আস্তে ঢালতে হবে।একবারে ঢালা যাবে না। পারলে ফোঁটা ফোঁটা করে ঢালুন।
তারপরে আপনি দেখতে পারবেন এক চমকপ্রদ কাহিনী যে চিনির পানির লেয়ার আর চা পাতার লেয়ার দেখবেন মিলে যাবে না।অর্থাৎ চিনির লেয়ার আর চা পাতার লেয়ার মিলে যাবে না।সুতরাং আপনার দুই লেয়ার বিশিষ্ট চা হয়ে গেছে একদম সহজে।
লেয়ার আরো বাড়াতে চাইলে আপনি এখন কনডেন্স মিল্ক টি একটু চিনি আর হাল্কা পানির সাহায্যে নেড়ে ফেনা করে ফেলুন।তারপর ঐ দুধের পাত্রে ঘন চা পাতার মিশ্রন্টি দুঢে ঢেলে দিন আস্তে আস্তে।
দেখতে পাবনে ফেনার সাহায্যে আলাদা লেয়ার দেখা যাচ্ছে।সুতরাং এইভাবে আপনি আপনার লেয়ার বিশিষ্ট চা বানাতে পারবেন একদম সহজে।
তাই এখন থেকে আপনার বাসায় কোনো অতিথি বা মেহমান আসলে এই লেয়ার বিশিষ্ট চা বানাতে পারেন এবং তারা অবশ্যই চমকে যাবে আপনার হাতের লেয়ার বিশিষ্ট চা প[ন করে।আর তাছাড়া কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে আপনিও বানিয়ে নিতে পারেন লেয়ার বিশিষ্ট চা।
চা নিয়ে যাবেন বাসার ছাদে।নীল আকাশ দেখবেন আর চা পান করবেন।হারিয়ে যাবেন অজানা কোনো এক ঠিকানায়।আর বৃষ্টি হলে তো কোনো কথাই নেই।
নীলকন্ঠ চা কেবিন কিভাবে যাবেন?
আপনাকে বাংলাদেশের যেকোন প্রান্ত হতে প্রথমে চলে আসতে হবে মোল্ভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে।শ্রীমঙ্গল বাস স্টপেজ বা রেল স্টেশনেে আসার পর সেখান থেকে আপনি অটোরিক্সা বা সিএনজি পেয়ে যাবেন।
প্রচুর পরিমানে অটোরিক্সা ও সিনএনজি পাওয়া যায়, আপনি দাড়ালেই উনারাই আপনাকে ডাকবে।
তারপর দরদামের সমঝোতা করে সোজা চলে আসতে পারবেন নীল কন্ঠ চা কেবিনে। ভাড়া জনপ্রতি বাস স্টেশন থেকে ৪০-৫০ টাকা লাগতে পারে। আসার পথে হাতের দুই পাশে আপনি দেখতে পারবেন সারি সারি রাবার বাগানের সমারোহ। যা আপনাকে সত্যি মুগ্ধ না করে পারবে না।
বেশী সময় লাগবে না আসতে। পৌছেই সামনে নীলকন্ঠের শেড দেওয়া চত্বর দেখা যাবে।

কিন্তু, বিকাল বা সন্ধ্যা নাগাদ গেলে জায়গা পাওয়া দুস্কর হয়ে দাড়াবে। আর ঢুকতে হাতের বাম পাশে অনেক গুলো জামাকাপড়, চাদর, নানান ধরনের তাঁতের শাড়ি আরো অনেক কিছু। আপনি চা নিতে চাইলে আগে কাউন্টারে চায়ের দাম দেওয়া লাগবে ।
তারপর টিকিট নাম্বার অনুসারে আপনি চা পাবেন। কিন্তু অপেক্ষা করা লাগবে ভাল সময়। কারন, আগেই বলেছি বিকালে চাপ থাকে খুব বেশী। অপেক্ষার পালা শেষ হলে আপনি পেয়ে যাবেন সেই বিখ্যাত চা।
বসে বসে চা পান করবেন আর সাথে যদি চোখ এদিক সেদিক ঘুরান তাহলে রমেশ রামের সাথে আমাদের বাংলাদেশের বিখ্যাত এবং সম্মানিত মানুষজন দের সাথে উনার ছবি। এমনকি রাষ্ট্রপতির সাথেও উনার এই সাত লেয়ার চায়ের ছবি আপনি দেখতে পাবেন।
আপনার উদ্দেশ্যে
আপনি যদি এতদূর পড়ে থাকেন তারমানে আপনি, নীলকণ্ঠ টি কেবিন এর সাত রঙের চা নিয়ে আগ্রহী আর এই পর্যায়ে আপনার, ৭ লেয়ারের চা পান না করে আর থাকা উচিত নয়!
তাহলে?
ভাই, তাহলে আপনাকে ভ্রমণপিপাসু হয়ে চলে আসতে হবে শ্রীমঙ্গল এর নীলকন্ঠ টি কেবিনে।
কবে যাচ্ছেন?
ভ্রমণচারীরা আরও জিজ্ঞেস করে
বাংলাদেশের দ্বিতীয় চা নিলাম কেন্দ্র কোথায়?
বাংলাদেশের দ্বিতীয় চা নিলাম কেন্দ্র মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত। ২০১৭ সালে দেশের দ্বিতীয় এ চা নিলাম কেন্দ্রটির উদ্বোধন করা হয়।
সিলেটের সাত রঙের চা কোথায় পাওয়া যায়?
সিলেটের সাত রঙের চা শ্রীমঙ্গলের নীলকন্ঠ চা কেবিনে পাওয়া যায়।