নুহাশ পল্লী (nuhash polli) মানুষের সৃষ্টি সত্বার আশ্চর্য নৈপুণ্যের মনোমুগ্ধকর আতুড়ঘর। দক্ষ শিল্পীর অকৃত্তিম হাতে সৃষ্ট হার মানানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার। সে শিল্পী আর কেউ নন, বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদ (Humyun Ahmed)।
হুমায়ূন আহমেদের নিজহাতে তিলে তিলে গড়ে তোলা আপন শান্তিনিকেতনটি গাজীপুর জেলার হোতাপাড়া ইউনিয়নের পিরুজালী গ্রামে অবস্থিত। অমর এই কথা সাহিত্যিক তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মত নিজ হাতে সুনিপুণভাবে সাজিয়েছেন এই নন্দন কাননটিকে।
১৯৯৭ সালে ২২ বিঘা জমির উপর স্থাপিত নুহাশ পল্লীর বর্তমান আয়তন প্রায় ৪০ বিঘা। হুমায়ুন আহমেদ এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের একমাত্র পুত্র নুহাশের নামে নুহাশ পল্লীর নামকরণ করা হয়েছে। লেখক ভালবাসতেন জীবনকে উপভোগ করতে, তাই ভেতর থেকে তিনি যা ভাবতেন তাকে বাস্তবে রুপ দিতেন।
তাইতো এক নিভৃত পল্লীতে নুহাশ পল্লী গড়ে তুলেছেন, শুধু তাই নয় তার উপন্যাসের বিখ্যাত সব চরিত্রও এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারে থাকাকালীন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম এবং আশ্চর্যজনকভাবে জীবনে এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মত অন্য কোনো অভিজ্ঞতা প্রভাব ফেলেনি আমার জীবনে।
চলুন শুরু করা যাক!
নুহাশ পল্লী কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে নুহাশ পল্লী যাওয়া খুবই সহজ ব্যাপার। আমাদের পৌছাতে হবে গাজীপুরের হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ডে। হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশা বা ইজিবাইক যোগে যেতে হবে নুহাশ পল্লীতে। এই যাত্রাকে দুইটা ধাপে ভাগ করা যাক।
ধাপ-১ঃ ঢাকা টু হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড
ঢাকা থেকে গাজীপুরে অসংখ্য বাস যায়। তবে বেশিরভাগ বাসই গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যায়। তাই সরাসরি হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যেতে হলে ময়মনসিংহ লাইনের বাসে উঠতে হবে। যে বাসগুলোতে চড়ে সরাসরি হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যেতে পারবেনঃ
- প্রভাতি-বনশ্রী পরিবহন
- সম্রাট লাইন
- রাজদুত পরিবহন
- ডাউন-টাউন
- ঢাকা পরিবহন
- বসুমতি পরিবহন
এখন আপনি যদি সরাসরি না যেতে চান বা আপনার সুবিধাজনক রুটে এই বাসগুলি না চলে তাহলেও চিন্তার কোনোই কারন নেই। সেক্ষেত্রে আপনাকে প্রথমে গাজীপুর চৌরাস্তা আসতে হবে। ঢাকার যেখানেই থাকুন না কেন গাজীপুর চৌরাস্তা যায় এমন বাস পাবেনই।
ভাড়া লাগতে পারে ৪০-৬০ টাকা(স্থানভেদে)। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে নেমেই হোতাপাড়াগামী বাসগুলির সারি দেখতে পাবেন। এগুলোর একটাই উঠবেন , জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১৫-২০ টাকা।
ধাপ-২ঃ হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড টু নুহাশ পল্লী
হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমেই ট্যাঁম্পু, অটোরিকশা বা ইজিবাইক পেয়ে যাবেন। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৪০- ৫০ টাকা।
বাস ব্যতিরেকে অন্যকোনো উপায়ে যাওয়া যায়?
আলবৎ!
আপনি চাইলে ট্রেনেও যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে সুবিধা-অসুবিধা উভয় রয়েছে। প্রথমেই অসুবিধার কথা বলি। প্রথমত সরাসরি হোতাপাড়া পর্যন্ত ট্রেনে যেতে পারবেন না। রাজেন্দ্রপুর ট্রেন ষ্টেশন পর্যন্ত যেতে পারবেন। দ্বিতীয়ত ট্রেনের সিডিউল ধরা এবং ট্রেন ষ্টেশনে আসার ঝামেলা।
এখন সুবিধার কথায় আসা যাক। আমার মনে হয় এই সামান্য অসুবিধা মেনে নিতে পারলে ট্রেনে যাওয়ার সুবিধার পাল্লায় ভারি হবে । এর সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে প্রচুর সময় বেঁচে যাবে। গাজীপুরে সড়ক পথে যে বিভিষীকাময় জ্যাম হয় সেকথা বোধহয় কারোর-ই অজানা নয়। ট্রেনে গেলে আপনি সর্বনিম্ন ৩-৪ ঘণ্টা সময় বাঁচাতে পারবেন।
সবই বুঝলাম কিন্তু ট্রেনে কিভাবে যাব?
কমলাপুর বা এয়ারপোর্ট রেলষ্টেশন চলে আসুন। এখন গাজীপুরগামী যেকোনো ট্রেনে উঠে পড়ুন। লোকাল ট্রেনে উঠলে ৫-১০ টাকা ভাড়া লাগবে। ট্রেনে করে গাজীপুরের জয়দেবপুর রেল স্টেশনে নামবেন। এখান থেকে লেগুনা অটোরিক্সাযোগে চলে যাবেন গাজীপুর চৌরাস্তা। এখান হোতাপাড়া যায় এমন অনেক বাস পাবেন।
আসল কথাঃ নুহাশ পল্লিতে কি কি দেখার আছে?
প্রাকৃতিক এবং কৃত্তিমতার অসাধারন মেলবন্ধনের মাধ্যমে সৌন্দর্যকে অনন্য মাত্রায় কিভাবে রুপ দেয়া যায়- নুহাশ পল্লীতে না গেলে বোঝা সম্ভব নয়।
আর এসবই লেখকের আশ্চর্য সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। নুহাশ পল্লিকে লেখক তার সৃষ্টিশীলতা দিয়ে তার মনের মত করে, উপন্যাসের চরিত্র দিয়ে সাজিয়েছেন। কল্পনার খেয়াই বসে যা অনুভব করেছেন, যা তার মনকে দোলুল্যমান করেছে তার সবই বাস্তব অস্তিত্ব দিয়েছেন।
নুহাশ পল্লী তার অস্তিত্বে প্রতি মুহূর্তে বয়ে চলেছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সম্রাট, কোটি কোটি পাঠকের পরম ভালবাসার লেখক হুমায়ুনকে।
কে ভালবাসার এই গর্বিত অনুভুতি উপভোগ করা থেকে দুরে থাকতে চাইবে? এই অনুভুতি ব্যক্ত করার বৃথা চেষ্টা করতে চাইনা। এই অনুভুতি নিতান্তই আপনার নিজের একান্ত।
আত্নিক এই ভাললাগাকে তাই আপনার উপর সোপর্দ করিয়া ইহার রূপ বর্ননা করতে উদ্যত হইলাম ?।
যাবার পথে
যাবার পথে যেতে যেতে চোখে পড়বে গ্রাম ব্যংলার হরেক রকমের গাছপালা, খেজুর গাছে রসের ঠিলা, হলুদে সরষেক্ষেত- শুনতে পারবেন নিস্তব্ধ গ্রামে পাখির কলকাকলী। আর মেঠো পথ? সে তো আপনাকে নিয়ে যাবে এক দূর অজানা কল্পলোকে!
সবুজে ঘেরা চিরসবুজ গ্রামের মধ্য দিয়ে যাবার পথে রোমান্থিত হয়ে যাবেন। মনে পড়বে শৈশবে কাটানো নিশচুপ সেইসব স্ম্তি। মুহুর্তেই হারিয়ে যাবেন এক প্রশান্ত জগতে।
প্রবেশদ্বারঃ ঢোকার জন্য অনেক খুব কৌতুহল ??
এতক্ষনে আপনি প্রতিক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছালেন।
এবারে প্রবেশের পালা। প্রবেশের জন্যে নুহাশ পল্লী দারুন কারুকারযখচিত এক বিশাল তোরণদ্বার নিয়ে অপেক্ষা করছে।
মা ও ছেলের ভাস্কর্যঃ ঢুকতেই যা চোখে পড়বে

স্থপতি আসাদুজ্জামান খানের তৈরি করা বেশকিছু ভাস্কর্য রয়েছে নুহাশ পল্লীতে। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই আপনি সর্বপ্রথম চমৎকার একটি ভাস্কর্য দেখতে পাবেন।
মা ও শিশুর এই ভাস্কর্যে দেখতে পাবেন স্নেহে সিক্ত শিশু তার ভালবাসার মাকে আঙুল দিয়ে সামনে কিছু দেখাচ্ছে। ভাস্কর্যটি মা ও সন্তানের মধ্যে আদি-অনাবিল সম্পর্কের চিরচায়িত দিকটি তুলে ধরেছে। ভাস্কর্যটির দিকে এক পলক তাকিয়ে আপনিও ফিরে যেতে পারেন দুরন্ত শৈশবে, মায়ের সাথে আহ্লাদ করা সেই মুহূর্তে।

সুইমিংপুলঃ আরে লেখক তো বেশ আধুনিক ছিলেন!
ভাস্কর্যের উপর থেকে চোখ সরালেই সামনে একটুখানি বাম ঘেঁষে দেখতে পাবেন হৃৎপিণ্ড আকৃতির সুইমিংপুল। এটি সহজেই দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।

সুনীল গঙ্গপাধ্যায়কে হুমায়ন আহমেদ যখন বাংলাদেশে আসার জন্যে দাওয়াত দিয়েছিলেন তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় “এত রক্ত কেন” নামের উপন্যাসটি লিখেছিলেন সুনীল জী।
উপন্যাসটিতে তিনি ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিতর্কিত যুক্তি দেন। এ সংখ্যাটি বাংলাদেশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং সুনীল গঙ্গপাধ্যায়ের ঢাকায় অবস্থানে নিষেধআজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে এয়ারপোর্টে পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় এই লেখকের প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল এবং ঢাকাতে অবস্থান করবেনা, এমন মুচলেকা দিয়ে কাস্টম পার হতে হয়। এরই সুবাদে সুনীল গঙ্গপাধ্যায়কে নুহাশ পল্লীতে নিয়ে যান হুমায়ুন আহমেদ। এখানে হুমায়ুন আহমেদের সাথে এই সুইমিংপুলেই সাতার কেটেছেন।
উল্লেখ্য, বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও সুইমিংপুলে গোসল করার সুযোগ পায়। কি সুন্দর, তাইনা?
মানুষের মাথার বিশাল কঙ্কালঃ আঃ ভয় পাবেন না কিন্তু?
সুইমিংপুলের পূর্বদিকে স্থাপন করা আছে মানুষের মাথার বিশাল কঙ্কাল যা দেখে বাচ্চারা খুব মজা পেতে পারে। মাথার কঙ্কালটি হাঁ করে থাকে এবং মুখ দিয়ে পানি বের হয় যা সুইমিংপুলে স্বচ্ছ পানি সরবরাহ করে।
মাটির টালির ছাউনি দেওয়া ঘরঃ যত্তসব আজগুবি?
বৈচিত্রময় ও বর্ণাঢ্য লেখক বিকালবেলা স্বপরিবারে এখানে বসে নাস্তা করতেন এবং ম্রদু-মন্দ বাতাসে নুহাশ পল্লীর সবুজ মাঠের দোলুল্যমান ঘাস, গাছপালা অবলোকন করতেন।
সুন্দর না?
হোয়াইট হাউসঃ ভাই আমেরিকার হোয়াইট হাউজ না
সুইমিংপুল একটু বামে পেছনদিকেই রয়েছে হুমায়ূন প্রিয় বাস ভবন হোয়াইট হাইজ।
[ একদম উপরে যে ছবিটা দিয়েছি সেটা হোয়াইট হাউজ ছাড়া অন্য কিছুর নয়]
অসাধারন নির্মাণশৈলীর এই বাড়িটির ডিজাইন করেন লেখকের খুব কাছের বন্ধু ইঞ্জিঃ এম এ করিম। ২০০১ সালের দিকে এ বাসভবনটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটির লেখক এমনভাবে ডিজাইন করান যাতে করে রুমের ভেতরে জোৎস্নার আলো প্রবেশ করতে পারে।
আরেহ বাহ!
হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরালঃ সুন্দর লাগার মত [আমার লাগে]

হোয়াইট হাউজের ঠিক সামনেই রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের বিশাল এক ম্যুরাল।
ম্যুরালটি যেকোনো পর্যটকেরই ভাল লাগতে বাধ্য। ম্যুরালটিতে ভাবুক মহিমায় বাম দিকে তাকিয়ে বসে থাকা লেখককে দেখা যাবে। অসাধারন এই ম্যুরালটি তৈরি করেন আর্কিটেক্ট হাফিজ উদ্দিন। হুমায়ুন আহমেদের ৬৬ তম জন্মদিনে ম্যুরালটি উদ্ভোদন করেন লেখকের ২য় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
বিশাল মাঠঃ ঘাসগুলো যে কত্ত সবুজ!
প্রবেশের পর সবার আগে চোখ চলে যাবে বিশাল মাঠের সবুজ গালিচার উপর। নিয়মিত পরিচর্যায় গড়ে তোলা ঘাসের গালিচা আপনাকে মুহূর্তেই বিমোহিত করে তোলার জন্যে যথেষ্ট।

ট্রি হাউসঃ কীহ! গাছের উপর বাড়ী?
বিখ্যাত ট্রি হাউজ।
গাছের উপর নির্মিত ঘর। বিভিন্ন উপন্যাসে লেখক এধরনের বাড়ির প্রতি গভীর অনুরাগ দেখিয়েছেন। উপন্যাসের কল্পিত এই বৃক্ষবাড়িটি নুহাশ পল্লীতে বাস্তবে রুপায়ন করেছেন. দর্শনার্থীদের আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এই ট্রি হাউজ।
গাছের উপর অভিনব কায়দায় টিনের তৈরি এবং স্টিলের কাঠামো দ্বারা তৈরি এই বাসাটি আপনার মন কেড়ে নিবে। বিশেষ করে বাচ্চারা অনেক মজা পাবে। গাছের উপর থাকায় এই বৃক্ষ-বাড়িটিতে উঠতে স্টিলের একটি মই রয়েছে।
বৃষ্টি বিলাসঃ যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো…এক বরষায়…
কথাসম্রাট বৃষ্টি ভালবাসতেন। ভাবতে পারেন কে না ভালবাসে।
না। লেখকের এই ভালবাসা ছিল অন্যরকম। উপভোগের আনন্দ আয়েশ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। তারই জ্বলন্ত প্রমান “বৃষ্টি বিলাস”। টিনের তৈরি এই বাড়িতে বসে বৃষ্টির ঝুম-ঝুম আওয়াজ শুনতেন।
বাড়িটির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বারান্দা। ঠিক সামনেই রয়েছে একটি বিশাল দোলনা।

উল্লেখ্য বেড়াতে আসা পর্যটকেরা বৃষ্টি বিলাসের বারান্দার খাটে বসে বিশ্রাম নিতে পারে।
লীলাবতীর ভাস্কর্যঃ পরিচিত লাগছে?
হুমায়ুন আহমেদ ও শাওনের প্রথম কন্যা সন্তান যে পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বেই মারা গিয়েছিল তার একটি কাল্পনিক ভাস্কর্য রয়েছে পল্লীতে। হুমায়ুন আহমেদ এই কন্যটির নাম দিয়েছিলেন “লীলাবতী”। হোয়াইট হাউজ ও বৃষ্টিবিলাসের মাঝখানে কদম গাছের তলায় লেখক যেখানে বসে চা খেতেন, তার সামনেই রয়েছে ভাস্কর্যটি।
অসাধারন সুন্দর এই ভাস্কর্য দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। আমি নিজেও এই ভাস্কর্যটির দিকে অনেক সময় তাকিয়ে ছিলাম। ভাস্কর্যে দেখা যাবে লীলাবতী তার আপন মহিমায় উপুড় হয়ে বই পড়ছে।

লীলাবতি দীঘি
মৃত কন্যা সন্তানটির নামেই দীঘির নামকরন করেন লেখক ও তার স্ত্রী। নুহাশ পল্লীর অন্যতম আকর্ষণ এই লীলাবতী দীঘি। চাইলে বিশাল এই দীঘিতে মনের হরষে সাতার কাটতে পারবেন, গোসল করতে পারেন। তবে সাতার না জানলে দীঘিতে না নামায় উত্তম কারন এর গভীরতা অনেক বেশি এবং এক পাড় থেকে অপর পাড় পর্যন্ত দুরত্বটাও কম নয়।

নুহাশ পল্লীর মাঠ পেরিয়ে, পদ্ম পুকুর থেকে একটু সামনে আগালেই দেখতে পাবেন ঢালু রাস্তা। বৃষ্টি হলে এই রাস্তা সাবধানে পার হওয়া উচিত। ঢালু রাস্তার শেষ মাথায় আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে শান্ত সুনিবিড় লীলাবতী দীঘি।
লীলাবতি দীঘির সামনেই রয়েছে বিখ্যাত ভুত বিলাস।
পবন ঝাউ গাছ ও ৭০ টি তাল গাছ
খেয়ালী লেখকের পাখি প্রেম ও ছিল অসামান্য। বিশেষ করে বাবুই পাখির প্রতি তার ভালবাসা ছিল অন্যরকম। বাবুই পাখির বাসা বানানোর উদ্দেশ্যে তিনি লীলাবতী দীঘির উত্তরে ৭০ টি তাল গাছের চারা রোপন করেন। এছাড়া লেখক লীলাবতী দীঘির পশ্চিম পাশে লাগিয়েছিলেন এক ঝাক পবন ঝাউ গাছ।
জমিদারী ঘাঁট
লীলাবতী দীঘির উত্তর প্রান্তে শান বাধানো জমিদারি ঘাঁট রয়েছে। এই ঘাটেই বহু জনপ্রিয় টিভি নাটক ও সিনেমার শ্যুটিং করা হয়েছে।
জমিদারি ঘাঁট থেকে পাড়ের উপরে রয়েছে শ্যুটিং এর জন্যে নির্মিত বেড়ার তৈরি দুইটি ঘর।
লীলাবতী দ্বীপ
লীলাবতী দীঘির ঠিক মাঝখানে লেখক তার শখের দ্বীপ তৈরি করেছেন। উচু মাটির ঢিবি দিয়ে বানানো ছোট এই দ্বীপটাতে বসে কবি উদাস মনে দীঘির নির্মল ঝিরঝির বাতাস অনুভব করতেন। বিকাল বেলা ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে এখানে বসলে আপনিও হারিয়ে যেতে পারেন অজানা কোনো কল্পনায়। দ্বীপটিতে যাওয়ার জন্যে একটি কাঠের সাঁকো রয়েছে।

ভুতবিলাসঃ এ কেমন বিলাস?
হ্যা। নাম এর আক্ষরিক অর্থ দাড় করালে যা হয় সেটাই। ভুতবিলাস নামে এই বাড়িতে বসে লেখক কাল্পনিক ভুতের ভয়ের স্বাদ নেওয়ার চেস্টা করতেন। তবে খুব সম্ভবত লেখক এখানে বসে মিসির আলী সিরিজ লেখার সময় চরিত্রগুলোর জন্যে ভয়ের সময় তাদের মনস্তত্ব কিভাবে কাজ করে সেটা কল্পনা করতেন।
এ বাড়িটি “লীলাবতী দীঘির” সামনে অবস্থিত। ভুতবিলাসের ডিজাইন করেছিলেন মেহের আফরোজ শাওন। ভুতবিলাসে এখন কারও প্রবেশাধিকার নেই। তবে বিশেষ কোনো অতিথির জন্যে এটি খোলা হয়।
ঔষধি গাছের বাগান

পল্লীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঔষধী গাছের বাগান রয়েছে। লেখক তার গভীর পরিচর্যায় এখানে গড়ে তুলেছেন ৩০০-৪০০ প্রজাতির ঔষধী বৃক্ষ।
পদ্ম পুকুর
আয়াতাকার এই পদ্ম পুকুরটি লীলাবতীর ভাস্কর্যের পাশে অবস্থিত। স্বচ্ছ জলে ঘেরা পদ্মপুকুরের চারপাশ জুড়ে রয়েছে নানান ধরনের বিরল গাছপালা। লীলাবতী পুকুরের প্রবেশ গেটে রয়েছে বিরল “আইগতিতা গাছ” ও “নীলমণি লতা’।
মৎস্যকন্যা ও প্রাগইতিহাসিক কালের মূর্তি
পদ্ম পুকুরের ঠিক পাশেই দেখতে পাবেন সরোবরে পাথরে নির্মিত মৎস্যকন্যার বিশালাকার মূর্তি। এর একটু পাশে দেখতে পাবেন প্রাগইতিহাসিক কালের ডাইনোসরের মূর্তি।
চা, ও কফি বাগান ও উইশ ট্রি
বৃষ্টিবিলাসের পেছন দিকে লীলাবতী দীঘি যেতে ডানপাশে চা বাগান দেখতে পাবেন। চা বাগানের একটু ডানেই রয়েছে কফি বাগান। কফি বাগানের পাশে বিশাল একটি “ক্যাকটাস গাছ” রয়েছে। এই গাছটিকে লেখক নাম দিয়েছেন “উইশ ট্রি”।
হুমায়ূন আহমেদের সমাধি
সমাধির সাথেস রয়েছে ২ টি গেইট। একটি “পারিবারিক গেইট “নুহাশ পল্লীর ভিতর দিক থেকে এটি দিয়ে শুধু পরিবার ও প্রিয়জনরা প্রবেশ করবে। আর অন্যটি “পাবলিক গেইট” বাইরের দিক থেকে এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত । আপনি যদি সমাধি থেকে পারিবারিক গেইট দিয়ে সোজা সামনের দিকে হোয়াইট হাউজের দিকে তাকান তাহলে কদম গাছের নীচে নীল দরজার যে রুমটি আপনার চোখে পড়বে সেটিতেই হুমায়ূন আহমেদ থাকতেন।

নুহাশ পল্লী যাবার উপযুক্ত সময়
নুহাশ পল্লী সারা বছরই খোলা থাকে। তবে আমার মতে, ঘুরতে যাবার উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল। এ সময় বেড়াতে গেলে সবটুকু মজা উপভোগ করতে পারবেন। বিখ্যাত লীলাবতী দীঘিতে সাতার কিংবা সুইমিংপুলে গোসল সবই সম্ভব কেবল যদি গ্রীস্মকালে বেড়াতে যান।
নুহাশ পল্লীর সময়সূচী
সারাবছর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে, এখানের পরিবেশ এবং উপভোগ করার মত সবকিছু গ্রীষ্মকালের জন্য আদর্শ।
ভ্রমণচারী টিপস
- সাথে গামছা/তোয়ালে নিয়ে যাবেন। সুইমিংপুলে বা দীঘি লীলাবতীতে গোসল করতে খুব সুবিধা হবে
- ঢাকা থেকে ভোরে রওনা দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে কেননা ঢাকা-গাজীপুর রুটে মারাত্নক জ্যাম হয়। সবচেয়ে ভাল হয় ট্রেনে গাজীপুর পর্যন্ত প্রচুর সময় বেঁচে যাবে।
- অনেক শিক্ষার্থীরাই জানেনা যে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে প্রবেশমুল্যে কিছুটা ছাড় আছে; বিশষত বন্ধুরা অনেকে মিলে গেলে মোট মুল্যের উপর ভাল ছাড় পাওয়া যায়।
- ট্যুর প্যাকেজ ছাড়া গেলে খাবারের আয়োজন করা হয়না। ভিতরে খাবারের দোকান নেই। আশেপাশেও পাবেন না। তাই হোতাপাড়া বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে খাবার কিনে নেওয়া উচিত।
- ফ্যামিলি ট্যুর দিলে রান্না করে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে।
ট্যুর বাজেট প্লান
সর্বসাকুল্যে ট্যুর বাজেটঃ ৫৮০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা।
যাত্রা খরচ
সরাসরি বাসযোগে
ঢাকা টু হোতাপাড়া বাজার বাসস্ট্যান্ডঃ ৬০-১০০ টাকা(বাসস্টপেজ ও বাসভেদে)
হোতাপাড়া টু নুহাশপল্লী- ৪০ টাকা
সর্বমোটঃ ১০০ থেকে ১৪০ টাকা
আবার বাস বদলি করে কাটা কাটা গেলে
ঢাকা টু গাজীপুর চৌরাস্তাঃ ৪০-৬০ টাকা (ঢাকার বিভিন্ন স্টপেজভেদে)
গাজীপুর চৌরাস্তা টু হোতাপাড়াঃ ১৫ টাকা
হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড টু নুহাশ পল্লীঃ ৪০ টাকা
সর্বমোটঃ ৮৫ থেকে ১০৫ টাকা
ট্রেনযোগে
কমলাপুর/বিমানবন্দর রেলস্টশন টু জয়দেবপুর রেলস্টেশনঃ ১০-২০ টাকা
জয়দেবপুর রেলস্টেশন টু গাজীপুর চৌরাস্তাঃ ১০ টাকা (লেগুনাযোগে)
গাজীপুর চৌরাস্তা টু হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ডঃ ১৫ টাকা
হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড টু নুহাশ পল্লীঃ ৪০ টাকা
সর্বমোটঃ ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা
খাবার খরচ
যদি ঢাকা থেকে রওনা দেন তাহলে নাস্তা করেই বের হতে পারবেন। সেক্ষেত্রে দুপুরের খাবারে খরচ লাগবে শুধু। হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ডে থেকে খুবই স্বল্প মুল্যে দেশীয় ঘরোঁয়া খাবার পেয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে আনুমানিক ১০০ থেকে ১২০ টাকা খরচ হবে। বিরিয়ানি/কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, মোরগ পোলাও খেতে চাইলে ১৩০-১৭০ টাকা খরচ হবে।
উল্লেখ্য, ভিতরে ব্যক্তি উদ্যোগে (ভাত+মুরগী+ভর্তা/সবজী) পাওয়া যায় ১২০-১৫০ টাকায় তবে সবসময় তা এভেইলএভেল নাও হতে পারে। আর মাত্র কয়েকজনের অর্ডার এরা নিতে চাইনা; গ্রুপে গেলে এখানে সুবিধা হবে।
নুহাশ পল্লীর প্রবেশ মুল্য
প্রবেশ টিকেট মুল্য ২০০ টাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা। ১২ বছরের নিচের বাচ্চারা বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারে।
তবে শুধুমাত্র মাজার জিয়ারত করতে চাইলে কোনো প্রবেশ মুল্য লাগেনা। আবার হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিবস (১৩-ই নভেম্বর) ও মৃত্যুবার্ষিকী (১৯ জুলাই)- এ দুইটি দিন বিনামূল্যে সর্বসাধারনের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
কোথায় খাবেন
পল্লীর ভেতর বা বাহিরে কোনো খাবারের দোকান নেই। তাই দুপুরের খাবারের জন্যে খাবার একমাত্র উপায় যাবার সময়ে হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে খাবার কিনে নিয়ে যাওয়া।
তাছাড়া ঢাকা থেকে পরিবারের সবাই মিলে গেলে বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে যাওয়া সর্বোত্তম।
কোথায় থাকবেন
নুহাশ পল্লী সকাল থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে বিশষ অনুরোধে ৬ টা পর্যন্ত খোলা রাখা যায়। তবে কোনোভাবেই রাত্রিযাপনের সুযোগ নেই। তবে, ভালো ব্যাপার এই যে, ঢাকা থেকে গেলে সহজেই ফিরে আসা যায়।
কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে আসলে আহামরি চিন্তার কারন নেই।স্বল্প দূরত্বের মধ্যেই অনেক হোটেল ও রিসোর্ট পেয়ে যাবেন। এছাড়া গাজীপুর জেলা সদরেও ভাল মানের প্রচুর হোটেল আছে।
শেষকথা
হুমায়ুনকে ভালবাসেন- নুহাশ পল্লী ঘুরে আসুন। হুমায়ুনের উপন্যাস, লেখাগুলি ভাল লাগে- অবশ্যই নুহাশ পল্লী ঘুরে আসুন।
আর বেশি কথা না বলে উপসংহারের যবনিপাত টানছি। এর পরও মোটিভেটেড না হলে ধরে নেওয়া যায় সাহিত্যরস নেই আপনার মধ্যে।
যাহোক, কমেন্ট করে জানাবেন যাচ্ছেন কিনা ? ভাল লাগবে।
আর আমাদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে, যেখানে ভ্রমণ সম্পর্কিত উপকারী ও প্রাকটিক্যাল নানান টিপস শেয়ার করে থাকি, যুক্ত হোন।
বারবার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহ
নুহাশ পল্লী কোথায় অবস্থিত?
গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামে।
নুহাশ পল্লীর বর্তমান মালিক কে?
প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উত্তরাধীকারীগণ।
নুহাশ পল্লীতে খাবার ব্যাবস্থা আছে?
না। তবে গ্রুপে অনেকে মিলে গেলে খাবার অর্ডার করা যায়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্রামের নাম কি?
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্রামের নাম পিরুজালী।
নুহাশ পল্লী কবে বন্ধ থাকে?
নুহাশ পল্লীর কোনো বিশেষ ছুটির দিন নেই। অর্থাৎ, অনিবার্য কারন ছাড়া সপ্তাহের ৭ দিন খোলা থাকে।
সত্যিই নুহাস পল্লির সকল স্বাধই লেখার মধ্যেই মিটে গেল যে, খুব সুন্দর বিবরণ।
আপনি কত তারিখে গিয়েছিলেন ?
জল কণ্যার ছবি দেননি কেন ?
কেয়ার টেকারের নম্বরটা হবে প্লিজ ?
চির কৃতজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে ২০১৮ সালের গ্রীস্মে গিয়েছিলাম। জলকন্যার ছবিটা কোনো কারনবশত যুক্ত করা হয়নি হয়ত, আপনাকে ধন্যবাদ যে মনে করিয়ে দিলেন। আর হ্যা, কেয়ারটেকারের নাম্বারের ব্যাপারে এই নাম্বারটিতে চেষ্টা করে দেখতে পারেন-০১৯১১৯২০৬৬৬
খুবই সুন্দর এবং সাজিয়ে-গোছিয়ে অনেক তথ্যবহুল আলোচনা করেছেন।ধন্যবাদ আপনাকে।